শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),১৮ সেপ্টেম্বর : পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর বিধানসভা হলো রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর নির্বাচনী ক্ষেত্র । কিন্তু নিচের নির্বাচনী ক্ষেত্রে এসে বারবার বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে । আজও ‘সিদ্দিকুল্লা দুর হঠো’ শুনতে হয়েছে রাজ্যের এই ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে । ক্ষিপ্ত মন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা আহমেদ হোসেন শেখকে “জমি মাফিয়া” ও “ক্যান্সার আক্রান্ত” বলে কটাক্ষ করেছেন । পালটা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ষক, চোরেদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন মন্তেশ্বরের মুরুলিয়া গ্রামের তৃণমূল নেত্রী সাফিয়া খাতুন । তিনি আরও একটা চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেছেন । সাফিয়ার অভিযোগ যে আজিবুর রহমান মণ্ডল নামে যে তৃণমূল নেতার যৌন নির্যাতনের কারনে একজন হিন্দু বধূর সংসার ভেঙে গেছে, সেই নেতাকে নিয়েই এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মন্ত্রী । মোটের উপর ২০২৬ সালের বিধানসভার ভোটের আগে মন্তেশ্বরে শাসকদলের গোষ্ঠী কোন্দল এখন চরমে পৌঁছে গেছে।
জানা গেছে,রাজ্যের মন্ত্রী ও মন্তেশ্বরের তৃণমূল বিধায়ক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আহমেদ হোসেন শেখের দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছে । বিবাদের মূল কারণ হলো এবারের বিধানসভার টিকিট পাওয়া নিয়ে । দলীয় সূত্রে খবর, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী ফের মন্তেশ্বর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান । কিন্তু আহমেদ হোসেন শেখ দলীয় প্রতীকে লড়াই করতে চাইছেন । যার জেরে বিধায়ক ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র বিবাদ এর সৃষ্টি হয়েছে । দিন কয়েক আগে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল মন্ত্রীকে । তার গাড়িতে হামলাও চালানো হয় । তিনি বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়েরও করেন । গ্রেপ্তারও হয় কয়েকজন । তারপর থেকে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চরম আকার ধারণ করেছে ।
জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার বিকালে মন্তেশ্বর ব্লকের মুরুলিয়া গ্রামে শারদীয়া এবং ঈদ-উল-ফিতার উপলক্ষে বস্ত্র বিতরণ করতে এসেছিলেন মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী । কিন্তু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কাউকে আগাম না জানানোয় মুরুলিয়া গ্রামের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ৷ সন্ধ্যা নাগাদ যখন মন্ত্রী গাড়িতে চড়ে ফিরে যাচ্ছিলেন সেই সময় ‘সিদ্দিকুল্লা দূর হটো’ স্লোগান দেওয়া হয় ।
পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর নেতা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আহমেদ হোসেন শেখের নাম না করে তাকে “জমি মাফিয়া” ও “ক্যান্সার আক্রান্ত” বলে কটাক্ষ করেন৷ মন্ত্রী বলেন,’মন্তেশ্বরে জমি মাফিয়ারাজ চলবে না। সেই জমানা শেষ। অত্যাচার অন্যায় করে মারধর করে জমি কেড়ে নেওয়া চলবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই৷ রাজনীতির নামে ত্রাস, রাজনীতির নামে জমি দখল, রাজনীতির নামে মারপিট বন্ধ করে ভালো মানুষের রাজনীতি করতে হবে । মানুষের স্বাধীনতা এবং দলের প্রতি আস্থা আমরা ফিরিয়ে আনতে চাইছি ।’
সিদ্দিকুল্লা আরও বলেছেন,’ আমার কারোর সাথে কোনো শত্রুতা নেই । কেউ যদি ক্যান্সারের রোগী হয়, তাহলে ভাবতে হবে সেটা ক্যান্সার । ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে একটা ট্যাবলেট দিলেই সেরে যাবে, টাইফয়েড হলে ডোজটা আলাদা দিতে হবে । এখানকার যারা নেতা তারা টাইফয়েডের রোগী নাকি ক্যান্সারের রোগী, তারা নিজেরা বুঝতে পারছেন তারা কিসের রোগী ।
কেউ কারোর জমি দখল করবে না । হচ্ছে কি হচ্ছে না আমি বলবো না, তবে সার্বিক ভাবে আমি এও বার্তা দিলাম । কেউ দালালি খাবে না । মানুষ মারপিট করবে না । মোটরসাইকেল বাহিনী বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভয় দেখাবে, এটা হবে না ।’
অন্যদিকে মুরুলিয়া গ্রামের মন্ত্রী বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর তৃণমূল নেত্রী সাফিয়া খাতুন সিদ্দিকুল্লার বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন৷ তিনি বলেন,’আমরা মাজিগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরুলিয়া গ্রামবাসী ৷ আমাদের বুকে একটাই কষ্ট । আমাদের এখানে নির্বাচিত সদস্য আছে, উনি কি জানেন না ? আমি একটা সাধারণ ঘরের মহিলা, আমার কোন পদ নেই । আমি মহিলাদের দিকটা দেখি । আমি তৃণমূল পার্টি করি ।
উনি যে গ্রামে আসছেন, আমাদের দুঃখ একটাই যে আমাদের জানানো হল না ।’ তিনি বলেন,’২০২১ সালে বিধানসভার ভোটে যারা বিজেপির এজেন্ট বসেছিল এবং বিশ্বজিৎ পোদ্দারের (বিজেপি নেতা) কাছে যেত আর টাকা নিয়ে আসতো, সেই চোরদেরকে নিয়ে উনি আজকে গ্রামের শাড়ি বিতরণ করলেন । আমার প্রশ্ন একটাই, আমাদের গ্রামে যে একজন নির্বাচিত সদস্য আছেন তাকে কেন জানালেন না ? তার পদটা ছোট বলে ? আমাদের কোন পদ নেই বলে জানালো না ?’
এরপর সাফিয়া খাতুন মন্ত্রীকে কার্যত তুলোধুনো করে বলেন,’উনি মন্ত্রী বলে, বিশাল ক্ষমতা আছে বলে, পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতে শাড়ি বিতরণ করে গেলেন, এটা কি ওনার বিবেকে একটু বাধলো না ? আজকের দুশো মহিলা আমি ওখানে লাগিয়ে দিতে পারতাম । কিন্তু কোন মহিলা আজ ওখানে যায়নি । যাদেরকে নিয়ে আমরা দলটা করি তাদেরকে না জানিয়ে হঠাৎ করে এসেছে । তাই যায়নি ।’
সাফিয়ার অভিযোগ,’যারা গ্রামের আসামী, যারা অন্যজনের মড়াইয়ে ধান খুলে বিক্রি করে দিয়েছে, সু#ল দাসের মেয়েকে আজিবুর রহমান মণ্ডল নিজে যৌন নির্যাতন করেছিল । সেই কারণে আজকে ওই মেয়েটা শ্বশুর বাড়ির ভাত পায়নি । তার সংসার ভেঙে গেছে । আর সেই আজিজুল রহমান মণ্ডলকে নিয়ে আজ সিদ্দিকুল্লা সাহেব আমাদের গ্রামে এলেন । উনি মন্ত্রী হয়ে আমাদের গ্রামে এসেছেন এটা আমাদের গর্ব । কিন্তু আমাদের একটাই প্রশ্ন, আমাদেরকে কেন জানালো না ? কি কারনে আমাদেরকে না জানিয়ে উনি এই গ্রামে এলেন আজ ?’
তিনি বলেন, আমরা সিদ্দিকুল্লা সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম । উনি ক্যাবিনেট মন্ত্রী আমাদের গ্রামে আসছেন, আমাদের কিছু প্রশ্ন ছিল । কিন্তু প্রশাসন আমাদেরকে বলেছিল যে কোন প্রকার বিক্ষোভ দেখাবেন না । আমরা বিক্ষোভ দেখাতে চাইনি । কেবল সুষ্ঠুভাবে কিছু প্রশ্ন ওনাকে করতাম । সেই প্রশ্ন করার সুযোগটা আমাদেরকে দিল না । সেই কারনে মন্ত্রী ফিরে যাবার সময় আমরা ‘সিদ্দিকুল্লা দুর হঠো’ বলে সিদ্দিকুল্লাকে বিদায় দিয়েছি । চোরদেরকে নিয়ে যে মন্ত্রী গ্রামে এসে শাড়ি বিলি করে যাচ্ছে, যার কোন সংগঠন নেই, সেই রকম মন্ত্রী ঝামেলা করার জন্য আমাদের গ্রামে আসুক আমরা চাইনা । গ্রামের কোন লোকই ছিল না সিদ্দিকুল্লার সাথে । ওখান থেকে চিন্টু মোটরসাইকেল বাহিনী নিয়ে এসেছিল ভাড়া করে । ভাড়া করা লোক নিয়ে এসে সিদ্দিকুল্লা সাহেব এখানে সংগঠন দেখাতে পারবেন না । দম থাকলে দেখাক আজিজুল রহমান মণ্ডল ও চিন্টুর পিছনে পিছনে গ্রামের কতগুলো লোক আছে ।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন,’আজিবুর রহমান মণ্ডলের কি পদ আছে আমি জানিনা । ওই আজিজুল জানে যে সাফিয়া গোষ্ঠীর মেয়েদের নিয়ে সংগঠনটা করে । সকালে বেরিয়ে যাই সন্ধ্যে ঢুকি । কেন আজিজুল ভাই আমাকে ফোন করে বলল না যে সাফিয়া তোমাদের গ্রামে যাচ্ছি ?’ দেখুন ভিডিও 👇
জানা গেছে,বস্ত্র বিতরণ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় মন্ত্রীর গাড়িকে লক্ষ্য করে তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য সহ কয়েকজন ‘সিদ্দিকুল্লা দুর হটো’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এর আগে মন্তেশ্বরে বিডিও অফিসে মন্ত্রী, বিডিও, বিএমওএইচ-কে নিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতি বৈঠক করলেও পাশের পঞ্চায়েত সমিতির কক্ষে থাকা সহ-সভাপতি ও কর্মাধ্যক্ষরা তার সাথে একবারের জন্য দেখা করেননি । আজ মন্ত্রীকে কার্যত বয়কট করেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আহমেদ হোসেন শেখ ও তার গোষ্ঠীর নেতারা ।।