প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২২ জুলাই : পঞ্চায়েতের উদ্যোগে হওয়া র্যলিতে অংশ নেওয়া পড়ুয়ারা স্কুলে ফেরার পর তাঁদের দেওয়া হয়েছিল প্যাকেটজাত ঠাণ্ডা পানীয় ও কেক । আর তা খেয়েই শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়ে পূর্ব বর্ধমানের মেমারির নবস্তার আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা । তাঁদের মাথা ঘোরা ও গা বমি শুরু হয় । চিকিৎসার জন্য একটি চারচাকা গাড়ি ও একটি বাসে করে ৬২ জন অসুস্থ পড়ুয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।এই ঘটনার পরেই এলাকাবাসী ও অভিবাবকদের রোষ আছড়ে পড়ে নবস্তা ১ পঞ্চায়েত অফিসে। খবর পেয়ে মেমারি থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী সেখানে পৌছে লাঠি চার্জ করে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে আনে।কয়েকজনকে পুলিশ আটকও করেছে। পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রকৃত কারণ জানতে প্রশাসন তদন্ত শুরু করেছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে,বর্ধমান ২ ব্লকের নবস্তা ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এদিন একটি র্যালির আয়োজন করে।মূলত প্ল্যাসটিক ক্যারি ব্যাগ ও প্ল্যাসটিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের বার্তা দিতে পঞ্চায়েত এই র্যলির আয়োজন
করে।সেই র্যলিতে নবস্তার আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল পড়ুয়াদের যোগ দেওয়ানো করা হয়।গরমের মধ্যে কাট ফাটা রোদে প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে খুদে পড়ুয়ারা স্কুলে ফেরে ।তার পর পঞ্চায়েতের তরফে তাদের দেওয়া প্যাকেটজাত ঠান্ডা পানীয় ও কেক । তা খাওয়ার পর বিদ্যালয়েই একের পর এক খুদে পড়ুয়া অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। তা জানাজানি হতেই অভিভাবক মহলে ক্ষোভ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।বিদ্যালয়ে ছুটে যান পড়ুয়াদের অভিভাবকরা। অসুস্থ পড়ুয়াদের নিয়ে স্কুলে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।পরে ৬২ জন অসুস্থ পড়ুয়াকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে । এই ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পঞ্চায়েতকে কাঠগড়ায় তুলে প্রতিবাদে স্বোচ্চার হন স্থানীয় মানুষজন ও অভিভাবকরা ।
স্কুলের এক পড়ুয়ার অভিভাবক শেখ ইব্রাহিম বলেন, প্ল্যাসটিক ক্যারি ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের বার্তা দিতে নবস্তা ১পঞ্চায়েত র্যলির আয়োজন করে। সেই র্যলিতে আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয় । র্যালি শেষে খুদে পড়ুয়ারা স্কুলে ফিরলে তাদের প্যাকেটজাত ঠান্ডা পানীয় ও কেক খেতে দেওয়া হয়।তা খাওয়ার পরেই একের পর এক পড়ুয়া অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। পড়ুয়াদের পেটে ও মাথায় যন্ত্রনা, মাথা ঘোরা ও বমি ভাব দেখা দেয়।বিদ্যালয়ের অপর এক ছাত্রী রিয়া ঘড়ুই এর বাবা রণজিৎ ঘড়ুই বলেন ,’প্যাকেটে ভরা যে জুস ও কেক খেতে দেওয়া হয়েছিল তা খেয়েই তাঁর মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে’ । এই ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ
তোলার পাশাপাশি নবস্তা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরদ্ধেও তীব্র ক্ষোভ উগরে দেন শেখ ইব্রাহিম, রণজিৎ ঘড়ুই সহ অন্য অভিভাবকরা এই অভিযোগের বিষয়টি জানার পর জেলা প্রশাসনিক মহলও নড়ে চড়ে বসে ।
অসুস্থ খুদে পড়ুয়াদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে এদিন তড়িঘড়ি বর্ধমান হাসপাতালে পৌছান জেলাপরিষদের সহ- সভাধীপতি দেবু টুডু।পরে সবাধীপতি তথা বিধায়ক শম্পা ধাড়া ,জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলাম সহ অনেকে হাসপাতালে যান । তাঁরা পড়ুয়াদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেন । কেন এমনটা হল সেই ব্যাপারেও তাঁরা বিস্তারিত খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেন। দেবু টুডু বলেন ,’প্রকৃত কি কারণে খুদে পড়ুয়ারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে সেই বিষয়টি সম্বন্ধে পরিস্কার কিছু জানা যায়নি । পড়ুয়াদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে ।
সভাধিপতি শম্পা ধারা বলেন ,’প্ল্যাসটিক বর্জন নিয়ে হওয়া র্যলির শেষে পড়ুয়াদের যে খাবার খেতে দেওয়া হয় তা খাওয়ার পর পড়ুয়ারা অসুস্থতা অনুভব করে বলে খবর পাওয়া গেছে । ৬২ জন পড়ুয়ার বর্ধমান হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে’। জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বাগবুল ইসলাম বলেন,’ফুট পয়জন থেকে সম্ভবত এমনটা হয়ে থাকতে পারে ।’
সাতগাছিয়া(ওয়েস্ট) সার্কেলের স্কুল ইনস্পেক্টর শ্যামল জানাকে এদিনের ঘটনা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,’অউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাদের যে এদিন র্যলিতে হাঁটানো হবে তা আমাকে জানানো হয়নি । বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাধাকান্ত রায় এদিন আমায় জানায়,’র্যালি শেষে যে খাবার পড়ুয়াদের দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েত থেকেই দিয়েছিল“ । নবস্তা ১ পঞ্চায়েতের প্রধান সারদা হাজরা বলেন,’র্যলি শেষে পড়ুয়াদের যে খাবার দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েতেরই দেওয়ার কথা । কিন্তু পরে কি হয়েছে তা আমি জানি না ।’ বর্ধমান ২ ব্লকের বিডিও সুবর্না মজুমদার জানান,“র্যালি শেষে আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের যে খাবার দেওয়া হয় তা পঞ্চায়েত থেকেই দেওয়া হয়েছিল ।তবে ওই খাবার খেয়েই ফুড পয়জনের কারণে পড়ুয়ারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, এমনটা এখনই নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না । তবে ওই খাবারের নমুনা পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে । রিপোর্ট আসলে বিষয়টি পরিস্কার হবে বলে বিডিও জানিয়েছেন ।
যদিও বর্ধমান মেডিক্যালের সুপার চিকিৎসক তাপস ঘোষ জানিয়েছেন,’খাদ্যে ’বিষক্রিয়া’ থেকেই পড়ুয়ারা অসুস্থতা বোধ করেছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে । তবে হাসপাতালে আসা সবাই সুস্থ রয়েছে । এসডিপিও (বর্ধমান উত্তর ) তীর্থঙ্কর বিশ্বাস
জানিয়েছেন,যে দোকান থেকে খাদ্যসামগ্রী কেনা হয়েছিল, সেই দোকানটি আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ।
এদিকে এদিন পড়ুয়াদের অসুস্থ হয়ে পড়ার
ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলিও চরমে উঠেছে। বর্ধমান ২ ব্লক তৃণমূলের নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অরুণ গোলদার বলেন, আউশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাধাকান্ত রায় বিজেপির নেতা । তিনি গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছিলেন । স্কুলের বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ওই প্রধান শিক্ষক এলাকার বাসিন্দাদের ও অভিভাবকদের উস্কান । এর পরেই পঞ্চায়েত অফিসে বহু লোকজন চড়াও হয় । তারা পঞ্চায়েত অফিসে ঢুকে বেপরোয়া ভাবে সরকারী সম্পত্তি ভাঙচুর চালায় । প্রধান সাধনা হাজরা, উপ-প্রধান সুদীপ্ত মাজিল্য ও পঞ্চায়েত আধিকারিকদের মারধোর করে । পঞ্চায়েতের আসবাবপত্রও ভাঙচুর করা হয় ।
এই ঘটনার খবর পেয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কল্যাণ সিংহ রায় ও এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ ) সুপ্রভাত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌছান । পুলিশ লাঠি চার্জ করে বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দিয়ে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রনে আনে । অরুণ গোলদার এও বলেন,’মারধোরে পঞ্চায়েতের উপ- প্রধান মারাত্বক জখম হয়েছেন । তাঁকে মেমারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । ষেখান থেকে তাঁকে বর্ধমান হাসপতালে স্থানান্তর করা হয়েছে ।’ এলাকার সিপিএম নেতা শ্যামচাঁদ মুখোপাধ্যায়ও একই ভাবে দাবি করেন,’বিষয়টি মিটে যাওয়ার সময়ে বিজেপি অশান্তিটা পাকালো ।’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে এদিন ফোনে পাওয়া যায় নি । বিজেপির জেলা মুখপত্র মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র দাবি করেছেন, ‘রাধাকান্তর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে । পুলিশ নামিয়ে অন্যায় ভাবে পড়ুয়াদের অভিভাবকদের মারধোর করা হয়েছে ।’।