ভারত বিভাজনের তীব্র বিরোধী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনক ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ৷ ১৯৪১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেছিলেন,’মুসলিমরা যদি ভারতবর্ষের বিভাজন চায় তবে ভারতের সকল মুসলিমদের উচিত তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া উচিত ।’ তবে তিনি ভারত বিভাজন আটকাতে না পারলেও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ইসলামি শাসমের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেন । সেই সময় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এর বাড়িতে ভারত বিভাজন ও বাংলা বিভাজন নিয়ে আলোচনা হয় । সভায় সিদ্ধান্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও হিন্দু জেলা প্রতিনিধিদের নিয়ে দুটি আলাদা সভা হবে এবং সবার মতামত নেওয়া হবে। একটি সভার ফলাফলও যদি বাংলা ভাগ এর পক্ষে যায়, তবে বাংলা ভাগ হবে। সভায় বাংলা বিভাজনের বিপক্ষে ভোট দেয় মুসলিমরা । কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোট পড়ে বাংলা বিভাজনের পক্ষে । ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এখানে বড়সড় ভূমিকা পালন করেন । হিন্দুদের ভোটে অবশেষে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় বাংলাকে । নাম হয় পশ্চিমবঙ্গ ।
পরবর্তী কালে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লাগু করার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদে সরব কয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী । এজন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার ষড়যন্ত্রে শ্রীনগরের কারাগারা তিল তিল করে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল তাঁকে । জোটেনি ঠিকমত চিকিৎসা । নেহেরু কাশ্মীরে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েও এক সময়ের সহকর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেননি ।
ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলে দেখা যায়, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা চালু রাখলে অদূর ভবিষ্যতে যে সমস্যা হতে পারে সেটা আগেই উপলব্ধি করেছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী । এজন্য তিনি বারবার লোকসভার ভিতরে ও বাইরে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন। সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিষয়ে লেখা হয়, ‘Temporary, Transitional and Special Provision of Article 370’। যদিও পরবর্তী কালে আইনটিকে কার্যত স্থায়ীভাবে রেখে দিয়েছিল কংগ্রেস । সংবিধান প্রণেতার দ্বারা আইনটিতে সাময়িক, পরিবর্তনমুখী ও বিশেষ কথাগুলির মধ্যেও গুঢ় উদ্দেশ্য প্রতিভাত হয় ।
ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ ৩৭০ ধারা বিলোপ ও পারমিটরাজ বাতিলের দাবিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কাশ্মীর অভিযান করেন। ১৯৫৩ সালের ১১ই মে পাঞ্জাবের উধমপুরে শেষ সভা করে কাশ্মীরে প্রবেশের পথে গ্রেফতারি বরণ করেন তিনি । ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন জম্মু-কাশ্মীরের কারাগারে বন্দিদশায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় ৷ সেদিন থেকে এই মহান বঙ্গসন্তানের মৃত্যু নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে৷ এমনকী তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেক সময় অভিযোগের আঙুলও উঠেছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লার দিকে ৷ ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর মৃত্যু নিয়েও তদন্ত কমিশন হয়েছে। কিন্তু ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু নিয়ে কোনো তদন্তই হয়নি ।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বেড়ে চলে। হত্যা, লুন্ঠন, নারীর সম্ভ্রমহানি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রতিবাদে ১৪ এপ্রিল, ১৯৫০ নেহেরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েও সংখ্যালঘু নিরাপত্তা (পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা) ও নেহেরু- লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে লোকসভায় প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। অবশেষে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যু হয়। কংগ্রেসের মধ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তির ভর কেন্দ্রে শূন্যতার সৃষ্টি হয় । ১৯৫১ সালের অক্টোবরে অনেক চিন্তাভাবনার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকারের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে নতুন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি । ১৯৫২ সালের মে মাসে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ভারতীয় জনসংঘ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনটি আসন লাভ করে।শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি লোকসভায় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব দান করেন।লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। জনসংঘ ঐ সময় বিধানসভা ভোটে বাংলা প্রদেশে ৮টি আসন ও রাজস্থানে ৮টি আসন লাভ করে। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যদি সেই সময় পৃথক দল গঠন করে হিন্দুদের একজোট করার প্রয়াস না করতেন তাহলে আজ বাংলাদেশের হিন্দুরা যেভাবে শুধুমাত্র ধর্মীয় কারনে চুড়ান্ত নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন, একই রকমভাবে পরিস্থিতির শিকার হতে হত পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদেরও । অথচ খোদ পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত সেকুলার ও বামপন্থীরা বাংলার এই সুযোগ্য সন্তানকে বারবার কালিমা লিপ্ত করেছে এবং করে যাচ্ছে ।
কংগ্রেস এই মহান আত্মার কৃতিত্বকে অবহেলা করলেও ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রয়ান দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৩শে জুন দিনটি ‘বলিদান দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার । আজ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির প্রয়ান দিবসের দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করেছেন,’দেশের মহান সন্তান, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর শহীদ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভারত মাতার সেবায় তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তার গতিশীল ব্যক্তিত্ব দেশের প্রতিটি প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।’।