হাওড়া সাবওয়ে- চিত্র ১
হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি কাজে আটকে গিয়েছিলাম। আমার কাজটা এই গল্পে গৌণ। তাই সবিস্তারে গেলাম না। শুধু আমার দীর্ঘ সময় ওই স্থানে কাটানো এবং অভিজ্ঞতাটাই এই গল্পের প্লট বা মুখ্য বিষয়ে সহায়ক।
দিনটি ছিলো ১৫ ই জুন। সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। তাও সকাল থেকে ট্রেনের ভিড়ে একটুও কমতি দেখছি না। কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর যেন একটি বিশালাকার দানব সন্তান প্রসব করছে আর বাচ্চাগুলো পিল পিল করে ছুটে আসছে সিঁড়ির দিকে। এক ঝাঁক পিঁপড়া নির্দিষ্ট দিকে ধাবমান হলে ঠিক যেমন হয় অবিকল সেই একই রকম। অথচ ট্রেন থেকে অত লোক নামছে, একসাথে সিঁড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে, সাবওয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু ভিড় কখনো জমে যাচ্ছে না। আর সারাদিন ধরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে কতবার হচ্ছে তার হিসেব বোধ করি বিধাতাও রাখছেন না। এতো মানুষ যে রোজ ট্রেন যাত্রা করে সাবওয়েতে দাঁড়িয়ে না থাকলে বোধহয় জানতেও পারতাম না।
সাবওয়ের নিচে ডজন খানেক ছোট ছোট বাচ্চা ভিক্ষা করছিল। আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে ওদের দিকে লক্ষ্য করছিলাম। ট্রেন এলেই ওদের ছুটো ছুটি বেড়ে যায়। সবার কাছে গিয়ে শুধু হাত পাতা, প্রয়োজনে জামা কাপড় ধরে আলতো করে টেনে দৃষ্টি আকর্ষণ করা, ব্যাস এইটুকুই। বেলা দশটা বাজতেই একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে স্তম্ভিত হলাম। বাচ্চাগুলির মধ্যে একটু বড় যে বাচ্চাটি, বছর দশেক হবে, সে আরেকটি বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করল- ‘আজকে আমরা কতজন কাজ করছি রে?’ এই ‘কাজ’ কথাটি আমার মস্তিষ্কে এমন আঘাত করল যে এর প্রকৃত উত্তর কি হতে পারে তা আমার মস্তিষ্ক দিতে পারলনা । উল্টে আমার শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান, ভাল-মন্দ, বিচার এমন তলিয়ে গেলো যে ভিক্ষা কিভাবে কাজ হতে পারে বুঝতেই পারলাম না? কিছুতেই স্থির করতে পারলাম না নিজেকে। শিক্ষিত এবং বিচক্ষণ হিসেবে যে গর্ব আমাকে পেয়ে বসেছিল এই ছোট্ট শিশুর কন্ঠ নিঃসৃত শব্দ আমাকে এমন এক অদ্ভুত চিন্তায় নিয়ে গিয়ে ফেলল যার নিষ্কৃতি সহজে হবার নয় বুঝলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এই চিন্তার মধ্যে নতুন একটি ঘটনা পূর্বের ঘটনাকে মনের মধ্যে গেঁথে রাখবার পুনঃ আয়োজন করলো। দেখলাম ওই দশ বছরের ছেলেটার এক ডাকে সমস্ত ভিক্ষুক ছেলেমেয়েগুলো এক জায়গায় হয়ে গেল। একটি প্লাস্টিকের ঝোলা থেকে সকলকে একটি করে ছোট পাউরুটি দিতে লাগলো বছর দশেকের লিডার গোছের ওই ছেলেটি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সকলে রুটি খেয়ে আবার যে যার কাজে লেগে পড়লো।
হাওড়া সাবওয়ে- চিত্র ২
সকাল থেকেই দেখছি সাবওয়ের নিচে পাতিলেবু বিক্রি হচ্ছে- দশ টাকায় তিনটে। বাইরে সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। লোকের গায়ে লেগে থাকা বৃষ্টির জল ও জুতোর তলার নোংরা সাবওয়েটাকে পিচ্ছিল করে যাচ্ছে। সারাদিন ধরে আমি এইসব কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছি। কত রকম মানুষ কত রকম রং ঢঙের বাহার। এত কোলাহল। দম বন্ধ করে আসা একটা ভ্যাপসা গরম এই স্থানটাকে যেন ঠিক ট্রেনের চাকার মত সারাদিন দৌড় করাচ্ছে।
লক্ষ্য করলাম দুইজন বিক্রেতা পরস্পরকে বলছেন আজ বিক্রি বাট্টা জমছে না। সকাল থেকে লেবু প্রায় বিক্রি হচ্ছে না। বেলা প্রায় বারোটা হয়ে গেল। আর দেরি নয় চল শুরু করি। আমি ভাবলাম এরা কি শুরু করবে? কিছু একটা অদ্ভুত দেখবার আশায় এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
একজন বিক্রেতা জোরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করল দশ টাকায় তিন……..। আর একজন চিৎকার করতে শুরু করল দশ টাকায় চার……। কি অদ্ভুত আশ্চর্য ম্যাজিক দেখলাম আমি…..কিছুক্ষনের মধ্যে দশ টাকায় চারটের ঝুড়ি শেষ হয়ে গেল। খানিক পরে দেখি পাশের বিক্রেতার ঝুড়ি থেকে অর্ধেক লেবু নিয়ে চলে গেল ওই বিক্রেতা এবং আবার শুরু হল সেই চিৎকার……দশ টাকায় তিন….. দশ টাকায় চার। মিনিট দশকের মধ্যে ঝুড়ি আবার খালি হয়ে গেল।
সেই দিন এক শিক্ষা হলো আমার। মানুষের যে জিনিসের কেনার ইচ্ছা নেই, তা যদি সস্তায় পায়, মানে যে দামে অন্য জায়গায় বিক্রি হচ্ছে তার থেকে কম দামে পায় তাহলে নিজেকে বুদ্ধিমান বা লাভবান প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেও সেই জিনিস কিনবেই কিনবে। বর্তমানে অনলাইন শপিং এর নামে এইভাবে জিনিসপত্র বিক্রির বুদ্ধিটাও বোধ হয় সেদিনকার হাওড়া থেকে ধার করা। কারণ আমি নিজেও জিনিসপত্র যখন অনলাইনে কেনার জন্য খুঁজি তখন খুঁজে খুঁজে দেখি দাম কোথায় কম পাচ্ছি এবং সেখান থেকেই অর্ডারটা বুকিং করে দিই এবং গর্বের সাথে বলি গিন্নি দেখলে…. অফারটা ঠিক সময় নিয়ে নিলাম। সস্তায় পেলাম…….। এক কাপ চা দাও তো…..!