মালিনী আজ ভীষণ শান্ত। একরকম বাড়ির সকলের অমতে গিয়েই আজ তিনি সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। একা হাতেই সমস্ত ফর্মালিটিস সামলে স্বামীকে এসে বললেন , “চলো এবার আমাদের ব্রতর কাছে যাই।”
ঋতব্রতর নিথর দেহটার কাছে বসে মালিনী একফোঁটাও চোখের জল ফেললেন না। সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, “তোকে না হারাবার ব্যবস্থা করেছি।”
মেধাবী ঋতব্রত ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষা দিয়ে ‘এ’ গ্ৰেডেড অফিসার হয়ে নর্থ বেঙ্গলে পোস্টিং হয়েছিল। ব্যাচমেট কৃষ্ণকলি ছিল তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী। একসময় দুজনেই অনুভব করে বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্বের পর্যায়ে নেই। কৃষ্ণকলি কৃষ্ণাঙ্গী হলেও প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী। সে বুঝেছিল ঋতব্রতর মায়ের তাকে না-পসন্দ। ব্রতদের বাড়িতে গেলে যেভাবেই হোক ওকে এড়িয়ে যান। তাই ব্রতর থেকে একরকম সে পালিয়ে দার্জিলিংয়ের এক কনভেন্টে শিক্ষিকার চাকরি নেয়। পিছুটান বলতে ছিল ওর জ্যাঠামশাই যিনি ওকে এক অনাথআশ্রম থেকে এনে মানুষ করেছিলেন। এহেন কলিকে যে মালিনী মানবেন না তা জানা কথা।
প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেছে ব্রত আর কলি দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। গত সপ্তাহে দাদুর শরীর খারাপ শুনে ব্রত কয়েকদিনের ছুটিতে কলকাতায় ফিরছিল। সেসময়েই ভয়ানক এক গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম ব্রতকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা চালান। বাড়িতে খবর যায়।
এরমাঝেই একদিন মালিনী হঠাৎ দেখেন কৃষ্ণকলির জেঠুকে। একজন ওয়ার্ড বয়ের থেকে জানতে পারেন ল্যাবে কাজের সময় এ্যাসিডে ওনার মেয়ের চোখ দুটো একবারে নষ্ট হয়ে গেছে। মালিনীর মনে পড়ে ওনার মেয়ে তো কলি।অদৃষ্টের কি পরিহাস ! দুটো ভালোবাসার মানুষ এক জায়গায় থেকেও কতো দূরে।
এক সপ্তাহের দীর্ঘ লড়াই শেষে ডাক্তাররা জানান ব্রতর ব্রেনডেথ, আর আশা নেই। মালিনী কেমন যেন শক্ত হয়ে যান। ডাক্তারদের সাথে কথা বলে জীবনের সব থেকে বড়ো সিদ্ধান্ত নেন।
অপারেশনের পর ডাক্তার কলির চোখের পট্টি খুললে জেঠু ওকে একটা চিঠি দেন। যাতে লেখা-
স্নেহের কৃষ্ণকলি,
‘আজ সন্তানকে হারিয়ে আমি এক হতভাগ্য মা। কিন্তু ওকে হারাতে চাই না বলে তোর দিঘল চোখের তারায় ওকে বন্দি করে দিলাম। এবার তোর চোখের মণিকে তুই সামলে রাখ চোখের আলো করে।’।