জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,দক্ষিণ ২৪ পরগনা,০৫ জুন : গত ৩ রা জুন ২০২২ এর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হয়। মাঝে একটা বছর বাদ দিয়ে করোনার আতঙ্ক কাটিয়ে এটাই ছিল প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা। মেধা তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মূল স্রোতের সংবাদ মাধ্যমগুলো ভিড় করে মেধাবীদের বাড়িতে। গর্বিত মা-বাবার পাশে সফল সন্তানকে বসিয়ে শুরু হয় তাদের পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা। সঙ্গে মিষ্টি মুখও হয়। কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কারণ ও শহর থেকে বহু দূরে অবস্থিত সুন্দরবনের জি-প্লটের ‘মু বিভূতি মলিকের মেইয়ে আশালতা বটেক। মু থাকি ঐ লদী পাইড়ে শবর বস্তিতে। মাছ ধরি, ক্যাঁকড়া ধরি। আর মুর বাবা মা যায় ঐ সোদর বনে মধু লিয়ে আসতে ।’ এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৩১৯ নম্বর পেয়ে সে উত্তীর্ণ হয়েছে। গাদা গাদা নম্বরের ভিড়ে শহরের মানুষদের কাছে নম্বরটা হয়তো তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের। কিন্তু একটা নাই রাজ্যের বাসিন্দা শবর পল্লীর মেয়ের কাছে অনেক । লড়াইটা দীর্ঘদিনের, বহু পরিশ্রমের ফসল এই সাফল্য ।
২০১৬ সাল। কলকাতা শহরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নিঃস্বার্থ ভালবাসার উৎস এসওইউএল (Source Of Unconditional Love) শহর থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের জি-প্লটের শবর পল্লীতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। শবর বালিকাদের পড়াশোনার জন্য গড়ে তুলেছে একটি আবাসিক বিদ্যাশ্রম। সেই আবাসিক বিদ্যাশ্রমের প্রথম প্রজন্মের ছাত্রী হলো এই আশালতা। প্রসঙ্গত করোনার সময় শবর পল্লীর বাসিন্দাদের পাশে থেকে এসওইউএল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার জেলা শাসকের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে।
প্রথম সাক্ষাতে এসওইউএল এর আত্মা শুভঙ্কর ব্যানার্জ্জী তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন – লেখা পড়া শিখতে ইচ্ছে করে কি না? প্রশ্নটা শুনেই সে চমকে উঠেছিল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলেছিল – কে শিখাইবে? মুদের পেইটে ভাত লাই তো লিখা পড়া শিইখে কি হবেক? তবে পেইট ভরে খেইতে পাইলে শিখব না কেনে?’ তার মনের গভীর কোণে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছের কথা জানতে পেরে সমস্ত দায়িত্ব এসওইউএল নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। সেই শুরু।
সুন্দরবনের জি-প্লটের শবর কন্যার শুরু হয় পড়াশোনা। পরম মমতা ও যত্নে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাকে অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বিষয়গুলো রপ্ত করানোর চেষ্টা করেন। আশালতাও গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ ছ’বছর পর সাফল্য আসে। প্রথম প্রচেষ্টাতেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়
শবর পল্লীর ইতিহাসের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি আশালতা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় তার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাশ্রমের প্রচেষ্টাও সফল ।
সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে বাস করে আশালতারা। সেখানে জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। দু’মুঠো অন্ন জোগাতে জীবন মৃত্যুর সরু সুতোর ওপর ওদের জীবিকা নির্ভর করে। একটা মাত্র শাড়িকে অর্ধেক করে মা-মেয়েকে লজ্জা নিবারণ করতে হয়। সেই পরিবেশে বড় হওয়া মেয়ে আজ মাধ্যমিক পাশ। সুতরাং আনন্দ বা তাৎপর্য আলাদা তো হতে বাধ্য ।
এসওইউএল এর আত্মা শুভঙ্কর ব্যানার্জ্জী নিজেকে প্রচারের আলো থেকে শতযোজন দূরে সরিয়ে রাখেন। তাইতো তিনি শহর থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে আধুনিক সভ্যতার আলো এখনো এসে পৌঁছতে পারেনি সেখানে লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করতে বেশি ভালবাসেন। তার ছোট্ট প্রতিক্রিয়া – মানুষের জন্য কাজ করব তার জন্য প্রচার কেন ?
এসওইউএল এর অপর আত্মা হলেন শুভঙ্কর বাবুর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু চন্দন সেনগুপ্ত । আশালতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে সাফল্যের আবেগে তার কণ্ঠ রূদ্ধ হয়ে আসে। আনন্দে চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা জল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলেন – আশালতা আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে শবর পল্লীর সবাই। লতার মত ডালপালা মেলে ওই জাগাবে আশার আলো। হয়তো ওকে দেখে আগামী দিনে আরও অনেক আশালতা সাফল্যের দরজায় পৌঁছে যাবে ।
আর আশালতা লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল,’আমি তো কিছুই করিনি। মাস্টার মহাশয়রা যা বলেছেন আমি সেটাই করেছি। সে আরও বলে – আমি আরও পড়তে চাই, উচ্চ মাধ্যমিক, বি.এ, এম.এ পড়তে চাই।’ কথাগুলো বলার সময় তার চোখেমুখে ছিল দৃঢ়তার ছাপ। ছ’বছর আগের আশালতার কথার সঙ্গে সঙ্গে আচরণের কত পরিবর্তন! এটাই প্রকৃত শিক্ষার মাহাত্ম্য । সরকার বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কি পারে না আশালতাদের আশা পূরণ করার জন্য এগিয়ে আসতে ? প্রশ্ন বিভিন্ন মহলের ।।