প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৮ ডিসেম্বর : অসময়ের বৃষ্টিতে আলু ও ধান চাষে পর্যাপ্ত ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর থেকে একের পর এক চাষি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে রাজ্যের শস্যগোলা পূর্ব বর্ধমানে ।চাষের ক্ষতির জেরে হতাশায় এক দিনের ব্যবধানে জেলার তিন চাষি আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনই দাবি করেছে মৃত চাষিদের পরিবার।শীতের শুরুতে ’জাওয়াদের’ প্রভাবে টানা দু‘দিন অবিরাম বৃষ্টিপাত হয়েচলে । সেই বৃষ্টির জলে শস্যগোলার বিস্তির্ণ এলাকার আলু চাষের জমি ও জমিতে পড়ে থাকা কাটা ধান গাছ জলে ডুবে যায় ।আর তাতেই মাথায় হাত পড়ে যায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের । সরকার ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের পাশে না দাঁড়ালে শস্যগোলায় চাষি মৃত্যুর ঘটনা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন চাষি পরিবারের সদস্যরা ।
জেলার কালনা ২ ব্লকের বড়ধামাস পঞ্চায়েতের বিরুহা গ্রামের বাড়ি চাষি মানিক শেখের । গত শুক্রবার সকালে বাড়ির কাছের গোয়ালঘর থেকে উদ্ধার হয় ওই চাষির ঝুলন্ত মৃতদেহ । এই চাষির শ্বশুর শেখ সামসের দাবি করেন,তাঁর জামাই মানিক নিজের ৫ বিঘা জমি চাষ করার পাশাপাশি ’ঠিকায়’ জমি নিয়ে ধান ও আলু চাষ করতো । মহাজনী ঋণ ও গোল্ড লোন নিয়ে এবছর মনিক ১২-১৩ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ফেলেছিল । কিন্তু জাওয়াদের প্রভাবে দু’দিন ধরে যে বৃষ্টিপাত হয় তাতে মানিকের সব আলু চাষের জমি জলে ডুবে যায় । এমনকি অন্য যেসব জমিতে পাকা আমন ধান গাছ কেটে ফেলে রাখাছিল তাও জলে ঢুবে যায় । সামসের বাবু সহ পরিবারের অপর সদস্যরা জানান, চাষের এই অপূরণীয় ক্ষতি দেখে চরম দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন মানিক শেখ । ঋণ কিভাবে শোধ করবেন ,সেই দুঃশ্চিন্তায় মানিক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শেষমেষ এই দুঃশ্চিন্তাতেই চাষি মানিক আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে দাবি করেছেন তাঁর শ্বশুর শেখ সামসের ।
কালনার চাষির মৃত্যুর ঘটনার পর ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতে জেলার রায়না ১ ব্লকে ২ জন চাষির অস্বাভাবিক মৃত্যু হল। মৃত চাষিদের নাম জয়দেব ঘোষ (৪৩) ও গনেশ নারায়ন ঘোষ (৬৩)। রায়নার দেবীবরপুর গ্রামে জয়দেবের বাড়ি ।আপর মৃত নারায়নের বাড়ি রায়নার বনতীরে । শনিবার সকালে এই দুই চাষির ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে রায়না থানার পুলিশ । ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ গুলি পাঠানো হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।এই দুই মৃত চাষির পরিবার সদস্যরা দাবি করেছেন, সাম্প্রতিক নিম্নচাপে জেরে হওয়া অতিবৃষ্টিতে তাঁদের চাষ জমি জলে ডুবে যায়। বিঘের পর বিঘে জমিতে পড়ে থাকা কাটা ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আলু চাষেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে । জমি থেকে ধান-আলু কিছুই আর মিলবে না। এই অবস্থায় কি ভাবে ঋণ শোধ হবে, সংসার কিভাবে চলবে সেকথা ভেবেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান দুই চাষি ।শেষ পর্যন্ত মানসিক হতাশায় এই দুই চাষি আত্মহননের পথ বেছে নেন বলে পরিবার সদস্যরা এদিন দাবি করেছেন ।
দু’দিনে জেলায় তিনজন চাষির অপমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা বলেন,’চাষির মৃত্যুর খবর আমার কাছে আসেনি।তবুও আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি ।’ রায়না ১ ব্লকের বিডিও সৌমেন বণিক আবার বলেন,’আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধান করে জানতে পারছি, চাষের কারণে কেউ মারা যাননি। অন্য কোনও কারণ হয়তো মৃত্যুর পিছনে রয়েছে। পুলিশ ও কৃষি দফতরকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আমরাও আভ্যন্তরীণ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করছি ।’ রাজ্যের মুখ্য কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন,’চাষের জন্যে মৃত্যুর ঘটনার কোনও সম্ভাবনাই নেই। নিখরচায় বিমা করে দেওয়া হচ্ছে, সাত দিন আগে কৃষক বন্ধুর থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আলু চাষের তো ক্ষতিই নির্ধারণ হয়নি ! আগে থেকে কী ভাবে বলা সম্ভব চাষের ক্ষতির জন্যে কেউ আত্মঘাতী হয়েছেন ।’. রায়নার বিধায়ক তথা জেলা পরিষদের সভানেত্রী শম্পা ধারার দাবি,’রাজ্য সরকার চাষিদের পাশে রয়েছেন। নানা রকম সুবিধা দিচ্ছেন। চাষের কারণে কেউ আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হয় না ।’
বামপন্থী সংগঠন সারা ভারত কৃষকসভার পূর্ব বর্ধমানের জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেনের বক্তব্য, ‘অনড় মনোভাব ছেড়ে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ চাষিদের পাশে দাঁড়াক। তা না হলে এই ঘটনা আরও বাড়বে ।’ বিজেপির কিসান মোর্চার সাংগঠনিক জেলা (বর্ধমান সদর) সভাপতি দেবাশিস সরকার বলেন,’চাষিদের হতাশা বাড়ছে। সরকার পাশে না থাকলেও আমরা প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে যথাসাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করছি ।’।