প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ও দিব্যেন্দু রায়, বর্ধমান,০১ অক্টোবর : বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই অজয় নদের জল বাড়ছিল ৷ রাতের দিকে তা ভয়াবহ আকার ধারন করে । সৃষ্টি হয়েছে বণ্যা পরিস্থিতির । পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম,মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রাম ব্লকে অজয় নদের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়ে গেছে একাধিক গ্রাম । বিস্তীর্ণ এলাকার ধানজমি জলের তলায় । শুক্রবার কেতুগ্রামের চরকি গ্রামের কাছে ফাঁকা লরিতে আশ্রয় নিতে দেখা যায় বেশ কয়েকটি গৃহহীন পরিবারকে ।
কয়েকদিনের লাগাতার বর্ষণের জেরে জলস্তর বেড়েছিল নদ-নদীতে ।তার উপর জলাধার গুলি থেকে দফায় দফায় জল ছাড়ার কারণে দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী ,অজয় ,ভাগীরথী সহ সব নদি এখন জলে টইটুম্বুর।নদির জল উপচে পড়ায় পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম, কাটোয়া,মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম ,রায়না ও জামালপুরের বেশ কিছু গ্রাম জলপ্লাবিত হয়ে পড়েছে।পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনিক তৎপরতা জারি থাকলেও দুর্ভোগ চরমে উঠেছে জেলার বাসিন্দাদের ।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে বৃহস্পতিবার দামোদরে ২ লক্ষ ৪ হাজার ৩৮৬ কিউসেক জল ছাড়া হয় । এর পর এদিন দু’ দফায় ৪ লক্ষের বেশী কিউসেক জল ছাড়া হয় দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে। তারপর থেকেই বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করে দামোদরের জল । পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে এমন আশংকা করে বৃহস্পতিবারই প্রশাসনের তরফে নদি তীরবর্তী এলাকায় মাইকে প্রচার চালানো হয় । তৈরি রাখা হয় ফ্লাড সেন্টার সহ যে কোন ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার ব্যবস্থা ।বৃহস্পতিবার ঝাড়খণ্ডের শিকাটিয়া ও হিংলো ব্যারেজ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার জন্যে দুপুরের পর থেকে আউশগ্রাম, মঙ্গলকোট, কেতুগ্রাম ও কাটোয়ায় জল বাড়তে শুরু করে। অজয় নদে জল বাড়তে শুরু করায় ওই দিন থেকেই আউসগ্রাম ও মঙ্গলকোটের মানুষজনের উৎকণ্ঠা বাড়তে শুরু করে।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে,আউশগ্রামের ভেদিয়া অঞ্চলের সাঁতলা গ্রামের কাছে অজয়নদের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে সাঁতলা,সুয়ারাসহ ভেদিয়া, বাগবাটি, কল্যানপুর, ফতেপুর, আওগ্রাম, কাঁঠালবাগান, প্রভৃতি একাধিক গ্রামে । বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে অজয়ের জল বাড়তে থাকে । সময়ের সাথে সাথে ভয়ঙ্কর চেহারা নেয় অজয় । ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই অনেক পরিবার প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান । অনেকে বাধ্য হয়ে নদীবাঁধের ওপরেই তাঁবু খাটিয়ে রয়েছেন । স্থানীয়দের অভিযোগ, অজয় নদের বাঁধের সিংহভাগ অংশের সংস্কার হয়নি । যার ফলে জলের চাপ বাড়তেই বাঁধের দূর্বল অংশ ভেঙে গোটা এলাকা প্লাবিত হচ্ছে । ভুগতে হচ্ছে সাধারন মানুষকে । এদিকে বৃহস্পতিবার কল্যানপুরের কাছে অজয় নদের চড়ে গরু চড়াতে গিয়ে জলবন্দি হয়ে পড়া ৩ গ্রামবাসীকে প্রায় রাত আড়াইটে নাগাদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের বাহিনী। তবে তাঁদের ৩ টি গরু উদ্ধার করা গেলেও ৮ টি গরু নদীর জলে ভেসে গেছে বলে খবর । শুক্রবার দুপুরে সাঁতলা গ্রামের কাছে নদীবাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ পরিদর্শনে আসেন পূর্ব বর্ধমান জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা ।
এদিকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মঙ্গলকোটের মাজিগ্রাম অঞ্চলের কোঁয়ারপুর গ্রামের কাছে অজয়ের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে বলে জানতে পারা গেছে । কোঁয়ারপুর থেকে প্রাত দেড় কিলোমিটার দুরে মালিয়ারা গ্রামের কাছেও নদীবাঁধ ভেঙেছে ৷ মঙ্গলকোটের পশ্চিমাংশের কয়েকটি অঞ্চলে কার্যত বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে । অজয় নদ তীরবর্তী নতুনহাট বাজার জলমগ্ন হয়ে গেছে । প্লাবিত হয়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি ও দোকান । গৃহহীন পরিবারগুলি নতুনহাটের লোচন দাস সেতুর ওপর তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন । এছাড়া নতুনহাট-গুসকরা রোড ও নতুনহাট-কাটোয়া সড়ক সড়কপথ জলে ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে ৷
অন্যদিকে কেতুগ্রামেও বণ্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ৷ কেতুগ্রামের চরকি গ্রামের কাছে অজয় নদের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় অনেক ঘরবাড়ি ডুবেছে । বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি জলে তলায় । শুক্রবার চরকি গ্রামের ৮০ টি পরিবার সড়ক পথে দাঁড়িয়ে থাকা ফাঁকা লরিতেই আশ্রয় নিয়েছেন ।
কেতুগ্রামের তেওড়া, রসুই, চরকি ও বিল্লেশ্বর এই চার এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙে আশপাশের এলাকা ও কৃষিজমি প্লাবিত হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহনাওয়াজ । তবে কেতুগ্রাম ২ ব্লকের বিডিও সওকত আলি জানিয়েছেন,কোথাও বাঁধ ভাঙার খবর তাঁর কাছে নেই । তবে চরকি গ্রামের কাছে অজয় নদের বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন ।
জামালপুরের জ্যোৎশ্রীরাম অঞ্চলের দামোদর তীরবর্তী কিছু গ্রামে জল ঢুকেতে শুরু করায় বালির বস্তা ফেলে জল ঢোকা বন্ধের ব্যবস্থা করা হয় । জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত জেলার ১৫টি ব্লকের একাংশ জলমগ্ন হয়।শুক্রবার সন্ধে পর্যন্ত জেলার ৯টি ব্লকের ৫৭ টি গ্রামে জল রয়েছে।এদিন পর্যন্ত জেলায় ৩৩টি ত্রাণ শিবির খুলতে হয়েছে। সেখানে প্রায় ৪ হাজার বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যা-পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ও সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ যাতে পৌছে দেওয়া যায় সেই কাজ তদারকি করতে শনিবার রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বর্ধমানে আসাছেন বলে খবর মিলেছে ।
জেলাশাসক প্রিয়াঙ্কা সিংলা এদিন বলেন ,’জল নামতে শুরু করেছে। যে সব জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে সেখানে জল নামলে সেচ দফতর কাজ শুরু করবে।বেশ কয়েকটি জায়গায় ত্রাণ শিবার খোলা হয়েছে । খাবার ও জলের পাউচ দেওয়া হচ্ছে । পরিস্থিতির দিকে প্রতিনিয়ত নজর রয়েছে।’।