সৌম্য ছোটবেলা থেকেই ছিল এক অদম্য মেধাবী ছাত্র। বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও তার স্বপ্নের পরিধি ছিল অনেক বড়। অভাব ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু তার চোখের উচ্চাশা, আর মনের মধ্যে অদম্য জেদ জীবনের সফল হওয়ার । মা-ই ছিল তার একমাত্র ভরসা, আর পাশের বাড়ির সূর্য মাস্টারমশাই—যিনি তাকে ছেলের মতোই দেখতেন। পড়াশোনার প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি বাঁকে সূর্য মাস্টারের সাহায্য আর উৎসাহ সৌম্যের জীবনের অন্যতম শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।
সৌম্যের শৈশবের সঙ্গী ছিল সূর্য মাস্টারের মেয়ে সঞ্চারী। দু’জনে পাশাপাশি খেলে, পড়াশোনা করে, একসঙ্গে বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হয়। সঞ্চারী ছিল তার বন্ধু, সহপাঠী, বিশ্বাসের জায়গা। সুখ-দুঃখের কত কথা, কত হাসি-কান্না—সব ভাগাভাগি করত তারা। সঞ্চারী সবসময় নিজের কাঁধে তুলে নিত সৌম্যের ছোটখাটো সমস্যা, আবার কখনো তাকে বুঝিয়ে দিত সাহস, আশ্বাস। কিন্তু সৌম্যের মনে কোনোদিনও আসেনি যে সেই বন্ধুত্ব একদিন জীবনের অন্য এক অধ্যায়ে পৌঁছে যাবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স, তারপর জিআরএফ পেয়ে পিএইচডি—সৌম্য ধাপে ধাপে নিজের সাফল্যের সিঁড়ি গড়ে তোলে। বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয় তার গবেষণাপত্র, যা নিয়ে গর্ব করে মা, গ্রাম, আর সূর্য মাস্টার। শেষপর্যন্ত সুযোগ আসে জার্মানিতে পোস্ট-ডক্টরেট করার। খবরটা শুনে মা, কাকা, বন্ধুরা সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে। শুধু সঞ্চারীই চোখের জলে ভিজিয়ে দেয় দিনগুলো—বিদায় যেন তার পক্ষে অসহ্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু সৌম্য কল্পনাও করতে পারেনি, তার জীবনের স্বপ্নপথ হঠাৎ ভেঙে যাবে।
জার্মানির যাবার ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলেছে, যাবার আগে মায়ের ইচ্ছেমতো সৌম্য মামার বাড়ি যায় দিদার সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ি ফেরার পথে ঘটে যায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা—একটি ডাম্পারের ধাক্কায় সৌম্য গুরুতর আহত হয়। দীর্ঘ ত্রিশ দিন কোমায় পড়ে থাকে।
যখন তার চেতনা ফিরে আসে, তখন সে প্রথম যাকে চোখে দেখে—সে সঞ্চারী। হাসপাতালের সাদা দেয়ালের ভেতর সেই মুখটাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। মা শোকে ভেঙে পড়লেও, সঞ্চারী-ই নিজের দায়িত্বে সবকিছু সামলেছে—ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, রাত জেগে পাহারা—সবকিছু। পরবর্তী সাত মাস ধরে সঞ্চারীর অক্লান্ত সেবায় সৌম্য ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
এই দুর্ঘটনা তার জীবনের স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সব পরিকল্পনা ওলটপালট করে দেয়। জার্মানির যাত্রা আর সম্ভব হয় না। জীবনের মানচিত্র একেবারেই বদলে যায়।
মায়ের ইচ্ছা আর নিজের কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে একদিন সৌম্য বিয়ে করে সঞ্চারীকে। অন্বেষা তখনও তার মনে রয়ে গিয়েছিল—অপ্রকাশিত, নিঃশব্দে। কিন্তু সঞ্চারীর স্নেহ, মায়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মায়ের ইচ্ছের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল সে।
আজ সৌম্যের সংসার তার স্ত্রী সঞ্চারী আর তাদের ছোট ছেলেকে ঘিরেই। সঞ্চারীর ওপর নির্ভর করে তার প্রতিটি দিন। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে অবলম্বন—সঞ্চারীই হয়ে উঠেছে তার জীবনের কেন্দ্র বিন্দু।
তবুও অন্তরের গভীরে অন্বেষা রয়ে গেছে—সেই অপূর্ণ, অউচ্চারিত সম্পর্কের স্মৃতি হয়ে। মুখে সে কিছুই বলে না, কাউকে বুঝতেও দেয় না। কিন্তু আকাশে মেঘ জমলে, নির্জনতার মুহূর্তে, তার ভেতরে কোথাও একটা অদৃশ্য ব্যথা গুমরে ওঠে—
“যদি জীবন অন্য পথে যেত…”
ক্রমশ…

