স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে সেভাবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করেও দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নজির স্থাপন করেছিলেন জহরলাল নেহেরু । তার একমাত্র গুণ ছিল যে তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রিয়পাত্র । দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বহু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে জহরলালকে । ভারত বিভাজনের জন্য তার ক্ষমতার লোভকেই দায়ী করা হয় । প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কাশ্মীর ও সিয়াচেন হাত ছাড়া হওয়া এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদ না পাওয়ার জন্য জহরলাল নেহেরুর অদূরদর্শিতাই দায়ী । জহরলালের বদান্যতায় চীন স্থায়ী সদস্যপদ হয়ে যায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে । নেহেরুর আর একটা ‘মহান কীর্তি’ ফাঁস হয়েছে । নেহেরু ভারতের পরমাণু বোমা তৈরির উপকরণ চীনের কাছে বিক্রি করেছিলেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি থেকে বড় প্রকাশ পেয়েছে ।
আসলে ১৯৫৩ সালের ১৭ জুলাই, দেশের আর্থিক রাজধানী মুম্বাই বন্দরে তখন ব্যাপক তৎপরতা । কিছু পণ্য পোলিশ জাহাজে দ্রুত বোঝাই করার কাজ চলছে । পন্য বোঝাই শেষে জাহাজটি প্রথমে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর মুখে যাত্রা করে,কলম্বো হয়ে চীনের টাকু বারে পৌঁছানোর কথা । কিন্তু এই জাহাজে এমন কিছু বোঝাই করা হয়েছিল যে এক সপ্তাহের মধ্যেই আমেরিকান কূটনীতিকরা সমুদ্রে এই জাহাজটিকে আটকে দেয় । ফলে জাহাজটা দিল্লির জলপথে ঘুরপাক খেত্ব থাকে । কি ছিল ওই জাহাজে ? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিতে বলা হয়েছে যে মুম্বাইয়ের এই জাহাজে ২,২৪৮ পাউন্ড থোরিয়াম নাইট্রেট বোঝাই করা হয়েছিল। থোরিয়াম হল সেই উপকরণ যা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। থোরিয়াম নাইট্রেট চীনের কাছে ভারতের সরকারি কোম্পানি ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়ালস লিমিটেড (IREL) মাত্র ৪০,৫০০ টাকায় বিক্রি করেছিল।। এই কোম্পানি ভারতে খনির কাজ করত। তখন পর্যন্ত ভারত-চীন যুদ্ধ হয়নি । ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু চীনকে ভালো বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করতেন । নেহেরুই তার ‘ভালো বন্ধু’ চীনক্স পারমাণবিক বোমা তৈরির উপকরণ বিক্রির অনুমতি দিয়েছিলেন।
নথিতে বলা হয়েছে,এই জাহাজটি ভারত ছেড়ে কলম্বো যাওয়ার পর ১৯৫৩ সালের ২১ শে জুলাই আমেরিকা এটি সম্পর্কে জানতে পারে। আর এতে দিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন কূটনীতিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেস অবিলম্বে ২৪ জুলাই, ভারতে তার রাষ্ট্রদূত জর্জ অ্যালেনকে চিঠি লিখেছিলেন। ফস্টার বলেছিলেন, ভারতের নেহেরু সরকার এই পারমাণবিক উপাদান বিক্রির অনুমতি দিয়েছে, তাই পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। তিনি তার রাষ্ট্রদূত অ্যালেনকে অবিলম্বে ভারত সরকারকে বোঝাতে বলেছিলেন যে এই জাহাজটি কলম্বোর বাইরে যাওয়া উচিত নয় বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন । চিঠি পাওয়ার পরপরই মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যালেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আরকে নেহরুর কাছে এই সংক্রান্ত তথ্য পাঠান। এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যালেন ভারতের অর্থমন্ত্রী চিন্তামন দেশমুখের সঙ্গেও দেখা করেন । আরকে নেহেরু বলেন, এখন শুধু প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুই কলম্বোতে এই জাহাজ থামাতে পারবেন ।
এই জাহাজ চীনে না পাঠানোর আবেদনের পাশাপাশি নেহরু সরকারকে মৃদু হুমকিও দিয়েছিল আমেরিকা। আমেরিকা বলেছিল, ভারত যদি এই জাহাজ চীনে পাঠায় এবং কমিউনিস্ট একনায়কত্বের অধীনে চীনকে পরমাণু সামগ্রী সরবরাহ চালিয়ে যায় তাহলে ভারতকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে আমেরিকা ।তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায়, আমেরিকার সাহায্য ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ দেশটি স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং উন্নয়নের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। সেই সময়ে বিদেশ থেকেও গম আসত। এই কথা বলে যখন কিছুই অর্জন করা সম্ভব হয়নি, তখন রাষ্ট্রদূত অ্যালেন নিজে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে ১৯৫৩ সালের ২৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬ টায় দেখা করেন। তিনি টেলিগ্রামের মাধ্যমে এই বৈঠকের পুরো তথ্য নিজ দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠিয়েছেন। অ্যালেন বলেছিলেন যে আমি সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে দেখা করেছি এবং আমি এই বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে তার সাথেও কথা বলেছি। জওহর লাল নেহেরু উত্তরে বলেছিলেন যে ভারত সরকার চাইলেও এই জাহাজটিকে থামাতে পারবে না।
নেহেরু বলেছিলেন যে এই থোরিয়াম নাইট্রেট একটি বিদেশী জাহাজে লোড করা হয়েছিল যা একটি বিদেশী বন্দরে ছিল। নেহেরুও এই বলে তার অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন যে ভারত সরকার যদি এমন পদক্ষেপ নেয় তবে চীনের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হবে। নেহেরু অ্যালেনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এটিকে একটি অসম্ভব কাজ বলে অভিহিত করেছিলেন। অ্যালেন তার দেশে বলেছেন যে শেষবারের মতো জানতে চাইলে নেহেরু বলেছিলেন, এ ব্যাপারে কিছুই করা যাবে না। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য আমেরিকাকে ভারতের সঙ্গে এই ধরনের পদার্থের ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি করতে হবে।
আসলে নেহেরু সেই সময় চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের ওপর জোর দিতেন। চীনে কমিউনিস্ট একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি তিব্বত সহ আকসাই চিন অঞ্চলে তার প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি করছিল। যাইহোক, নেহেরু এই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে দেশে ‘হিন্দি-চিনি- ভাই-ভাই’ স্লোগান তুলছিলেন।
উল্লেখ্য যে চীনের কাছে ভারতের থোরিয়াম বিক্রিতে আমেরিকা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে এটি ভারতকে ‘ব্যাটল অ্যাক্ট’-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আসলে, ব্যাটল অ্যাক্টের অধীনে, আমেরিকা নিষিদ্ধ যে কোনও দেশকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করতে পারে। এই তালিকায় থোরিয়াম নাইট্রেট অন্তর্ভুক্ত ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে তার রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন যে নেহরুর সরকার চীনের কাছে থোরিয়াম বিক্রি করে আমাদের সমস্যায় ফেলেছে। যুদ্ধ আইনের কারণে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি এবং তাই ভারতকে আমেরিকা যে সাহায্য দিয়েছে তা বন্ধ করতে হতে পারে।
১৪ আগস্ট, রাষ্ট্রদূত অ্যালেন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবার লিখেছিলেন যে আমাদের ভারতকে স্পষ্টভাবে বলা উচিত যে যদি তারা আমাদের কাছ থেকে সাহায্য প্রত্যাশা করে তবে তাদেরকে কিছু শর্ত মানতে হবে। এর আগে একটি চিঠিতে তিনি আমেরিকা থেকে ভারতের সমস্ত থোরিয়াম নাইট্রেট কেনার প্রস্তাবও করেছিলেন। কয়েক মাস ধরে চলা এই নাটকে এই থোরিয়াম নাইট্রেট পৌঁছে যায় চীনে। নেহেরু চীনের সাথে সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে এই জাহাজটি থামাতে অস্বীকার করেন। এই একই চীন ১৯৫৩ সালে তিব্বত দখল করেছিল যখন নেহেরু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৬২ সালে ভারতের ভূখণ্ডও সংযুক্ত করেছিল ।
অদূরদর্শী নেহেরু এই বিষয়ে সংসদে বলেছিলেন যে আকসাই চিনে ঘাসও গজায় না । আসলে দেশের স্বার্থের থেকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা মূল উদ্দেশ্য ছিল জহরলাল নেহেরুর কাছে । যদি তাই না হত তাহলে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর ভয়ে ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার’-এর নামে রাতারাতি দেশ স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র করতেন না তিনি । পাকিস্তানের নেপথ্যেও মহম্মদ আলি জিন্নার পাশাপাশি জহরলালের সমান ভূমিকা ছিল । এক্ষেত্রে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ভূমিকাও সন্দেহের উর্ধে নয় । আজও গান্ধী ও নেহেরুর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি এক শ্রেণীর ক্ষমতালোভী তাঁবেদার নেতাদের জন্য ।।