প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১০ আগস্ট : ঝাঁ চকচকে শিক্ষাকেন্দ্র আছে । পড়ুয়াও আছে । শুধু আকাল দেখা দিয়েছে শিক্ষকের।আর শিক্ষক আকালের কারণে একের পর এক শিক্ষা কেন্দ্রে স্তব্ধ হয়ে যেতে বসেছে পঠন পাঠন।ইতিমধ্যেই পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে (M S K) তালা পড়ে গিয়েছে । অপর কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি (SSK) কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন একজন মাত্র শিক্ষিকা।তবে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়াশুনার কোন বালাই নেই।পঠন পাঠনে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণীর পড়ুয়ারা অন্য স্কুলের প্রথম শ্রেণীর পড়ুয়াদের চাইতেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে । ছেলে মেয়েরা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়, আর মিড-ডে মিল খেয়ে বাড়ি ফিরে আসে দেখে হতাশ অভিভাবকরা ।
শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পথ করে দিতে ৯০-এর দশকের শেষের দিকে উদ্যোগী হয় রাজ্যের শিশু শিক্ষা মিশন সহ পঞ্চায়েত ও গ্রাম উন্নয়ন দফতর।সেইমত পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।বর্তমানে সেগুলি সর্বশিক্ষা মিশনের আওতাধীনে রয়েছে। জামালপুর ব্লকের আঝাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কেলিড়ী গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি সেই রকমই একটি।
শুরুতে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের পড়ানোর জন্য নিয়োগ করা হয় চার জন শিক্ষিকাকে।গ্রামবাসীদের আশাছিল তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার আলোকে আনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেবে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র।শুরুর পর থেকে নাকি সেটাই হচ্ছিল।কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে অভিভাবকদের সব আশা ফিকে হতে শুরু করে। তিনজন শিক্ষিকা অবসর নেওয়ার পর আর কোন শিক্ষিকা নিয়োগ হয় নি।এখন ৩৬ জন পড়ুয়াকে নিয়ে একমাত্র শিক্ষিকা শুভ্রা ব্যানার্জী শুধুমাত্র কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের অস্তিত্ব টুকু টিকিয়ে রেখেছেন।
কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে এখন পঠন পাঠন লাটে উঠে গিয়েছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।মণিরা খাতুন নামে এক ছাত্রের মা অভিযোগে বলেন,’আমার ছেলে সহ অন্য ছেলে মেয়েরা প্রতিদিন ব্যাগে বই খাতা নিয়ে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে শুধু খেলা করে আর মিড-ডে মিল খেয়ে বাড়ি চলে আসে। কি পড়ানো হল জিজ্ঞাসা করলে ছেলে মেয়েরা রোজই বলে তাদের পড়ানো হয় না।’ এ নিয়ে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকাকে বলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি বলে মণিরা খাতুন জানান ।খুদে ছাত্র ছাত্রীরাও জানায় তাঁদের পড়ানো হয় না ।
এলাকার বাসিন্দা শশাঙ্ক ভূমিজ বলেন,’খেতমজুর
অধ্যুষিত কেলিড়ী গ্রামে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর থেকে ভাল ভাবেই পড়াশুনা হচ্ছিল।তা দেখে এলাকার সব মা বাবাদের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তাঁদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার আর অসুবিধা হবে না।কিন্তু বিগত প্রায় চার বছর ধরে কেলিড়ী গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে লেখাপড়ার বিষয়টাই লাটে উঠে গিয়েছে। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি এখন শুধু মিড-ডে মিল খাওয়ার স্কুল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।ব্লক প্রশাসন ও স্থানীয় পঞ্চায়েতে সব জানানো হলেও শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পঠন পাঠনের হাল ফেরানোর কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।’ যে তিনজন শিক্ষিকা অবসর নিয়েছেন তাদের শূন্য জায়গায় নতুন শিক্ষক শিক্ষিকাও নিয়োগ করা হচ্ছে না বলে শশাঙ্ক ভূমিজ জানিয়েছেন ।
এবিষয়ে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষিকা শুভ্রা ব্যানার্জীর সাফ জবাব,’হ্যাঁ,এখানে পড়শুনার মান অনেক নেমে গেছে।কিন্তু কিছু করার নেই।আমার একার পক্ষে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এবং কেন্দ্রের চারটে শ্রেণীর ৩৬ জন পড়ুয়ার পড়াশুনার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করা সম্ভব নয় ।’
এদিকে কেলিড়ী ইটখোলাপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র যখন ধুঁকছে তখন পুরোপুরি কোমায় চলে গিয়েছে
জামালপুরের সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র।
বাম আমলে পাড়াতল-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের মুহিন্দর গ্রামে এই শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। মেয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে তোলার জন্য জমি দান করেছিলেন শিক্ষানুরাগী বাবা সুকুমার কুমার।২০০৭ সালে সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পঠন পাঠন শুরু হয়।শুরুর সময় থেকে দু’জন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষিকা সেখানে পড়াতেন।তখন পড়ুয়াদের কোলাহলে মুখর থাকতো এই শিক্ষাকেন্দ্র।এখন সবই ইতিহাস।শিক্ষকের আকাল দেখা দেওয়ার সাথে সাথে পড়ুয়ারাও এই এমএসকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া শুরু করে। এখন সুচেতা কুমার মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র শুধু অস্তিত্বের জানানটুকুই দিচ্ছে মাত্র ।
জামালপুরের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার বলেন,
‘আমরা উদ্ভুত সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না হলে এর স্থায়ী সমাধান কোনভাবেই সম্ভব নয়। ব্লকে এই সময়ে ৩১টি এস,এস,কে ও ২টি এম,এস, কে চালু রয়েছে।শিক্ষক ঘাটতির কারণে ব্লকের একটি এম,এস,কে বন্ধের প্রপোজাল জেলায় পাঠানো হয়েছে। নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না হলে চলতি বছরেই ব্লকে আরো ৪-৫ টি এস,এস,কে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে বিডিও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ।’
সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা দফতর থেকেও জানানো হয়,’শুধু জামালপুর নয় ,শিক্ষকের ঘাটতির জন্যে গোটা জেলায় অনেক এস,এস,কে এবং এম,এস,
কে তে পঠন পাঠন থমকে গিয়েছে শিক্ষক নিয়োগ হলে তবে এই শিক্ষাকেন্দ্র গুলি পুণরায় চালু করা সম্ভব হবে ।’
জামালপুরের প্রাক্তন বাম বিধায়ক সমর হাজরা এ বিষয়ে বলেন,শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে এখন জেরবার রাজ্যের শিক্ষা দফতর ।দুর্নীতিতে নাম জড়ানোয় প্রায় এক বছর ধরে শ্রীঘরে দিন কাটাচ্ছে বর্তমান সরকারের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী।রেহাই পান নি শিক্ষা দপ্তরের কর্তারাও । এসবের জেরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে থাকার মাঝেই জেল যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকতার চাকরি হাতানো শিক্ষকদের । এর ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে।এখন শিক্ষকের আকালের কারণে কোন কোন শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অস্থায়ী শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে ।’ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির ভবিতব্য এখন এমনটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান প্রাক্তন বাম বিধায়ক ।।