সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল হুল হলো ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি ঔপনিবেশিক ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন, যাকে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নেতৃত্ব দিয়েছিলো। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত বাংলার বীরভূম, ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলার সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের রাজস্ব ও কৃষি নীতির বিরুদ্ধে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন চার মুরমু ভাই- সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। ১৭৯৩ সালে বড়লাট (গভর্নর-জেনারেল) লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে তাঁদের প্রাচীন স্থানান্তর চাষ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা বিদ্রোহ গড়ে তোলে ৷
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। কোম্পানির শাসন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার আগে সাঁওতালদের জীবনযাত্রা ছিল সরল ও সাদাসিধে। কোম্পানির বাংলা দখল করার পর তারা সাঁওতাল জনজীবনের ওপর বাড়িয়ে দিয়েছিল শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা। তাদের এলাকায় কোম্পানি সরকার শাসন ও শোষণ অপেক্ষাকৃত মজবুত করার উদ্দেশ্যে জমিদার, দালাল, মহাজন, সরকারি আমলা ও দারোগা সৃষ্টি করে সাঁওতাল জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মহাজনরা সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করত। ধান-চাল ধার দেওয়ার সময় ওজনে ফাঁকি দিত। সাঁওতালরা যখন ধান-চাল পরিশোধ করত, তখন তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো কয়েক গুণ বেশি। ক্রমেই পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, বছরের পর বছর মহাজনের দেনা দশ গুণ পরিশোধ করেও সাঁওতালরা ঋণ থেকে মুক্তি পেত না। তাদের হালের গরু ও ফসল জোর কর কেড়ে নিয়ে যেত মহাজনরা। যেসব পরিবার দেনার দায়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেত, তাদের পরিবারের সব সদস্যকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো। মহাজন ছাড়াও ছিল এক শ্রেণীর দালাল। দালালরা নামমাত্র মূল্যে চাল, বোরা, সরিষা ও অন্যান্য তেলজাতীয় দ্রব্য বারহাইত নামক স্থান থেকে কিনে গরুর গাড়িতে করে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত জঙ্গীপুরে নিয়ে যেত। জঙ্গীপুর থেকে এসব দ্রব্য চালান দিত মুর্শিদাবাদ_ মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে যাওয়া হতো কলকাতায়_ কলকাতা থেকে মালগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হতো জাহাজে করে বিলাতে। জমিদাররা অশিক্ষিত, নিরীহ সাঁওতালদের কাছ থেকে চড়া হারে খাজনা আদায় করত এবং সে সঙ্গে আরও আদায় করত বেআইনি নজরানা।
এ অঞ্চলে শোষণ চালানোর জন্য বসতি স্থাপন করেছিল নীলকররা। তারা জোর করে নীলের চাষ করাত। রেলপথ নির্মাণের জন্য একদল ইউরোপীয় বাস করত এ অঞ্চলে। তাদের কাজ ছিল সাঁওতাল মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত, তাদের ওপর চালানো হতো কঠোর নির্যাতন। স্থানীয় সরকারি আমলা ও দারোগাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছিল যে, সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন ভাগনাদিহির মাঠে ১০ হাজার সাঁওতাল সিধু ও কানুর নেতৃত্বে সমবেত হয়েছিল। এ সমাবেশেই সিধু ও কানু সাঁওতালদের বিদ্রোহের নির্দেশ দেন। বিদ্রোহের বাণী চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে। প্রথমদিকে বিদ্রোহের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত। বিদ্রোহীদের তৎপরতার ফলে এ অঞ্চলে সরকারের ডাক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে এগিয়ে এলে বিদ্রোহীরা তাদের প্রতিরোধ করে। বিদ্রোহের আগুন শুধু ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত জ্বলে ওঠেনি, জ্বলে উঠেছিল গোদা, পাকুড়, মহেশপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে। জমিদাররা ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু জমিদাররা নয়, দেওঘর থেকে ম্যাজিস্ট্রেটও পালিয়ে যায়। মহেশপুরে পঞ্চাশ হাজার সাঁওতাল কোম্পানি সৈন্যের গতিরোধ করে। কোম্পানি বিদ্রোহ দমন করার জন্য রেজিমেন্ট নিয়োগ করে। কিন্তু তবুও বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানি সরকার বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ইংরেজ বড়কর্তারা আতঙ্কিত হয়ে লিখেছিলেন যে, সাঁওতালরা সশস্ত্র হয়ে ঘোরাফেরা করছে, তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজার। তাদের আত্মসমর্পণ করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ইংরেজরা ভেবেছিল, তাদের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে হয়তো সাঁওতাল বিদ্রোহীদের শক্তি ভেঙে পড়বে, কিন্তু পরিণামে দেখা গিয়েছিল উল্টো। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে আবার আগুন দ্বিগুণ জ্বলে উঠেছিল সাঁওতাল অঞ্চলে। হাজার হাজার বিদ্রোহী সাঁওতালের পদধ্বনিতে কেঁপে উঠেছিল কোম্পানির শাসন। নিরুপায় হয়ে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করতে বাধ্য হয়েছিল। সাঁওতাল নেতারা এ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে একটা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। তারা ঘোষণা করেছিল আমলাদের পাপে সাহেবরাও পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে, এ পাপের ফলে তারা যে দেশটিকে বেআইনিভাবে দখল করেছে, তা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তারা আরও ঘোষণা করেছিল, তাদের রাজ্যে কাউকে খাজনা দিতে হবে না। প্রত্যেকে সাধ্যমতো জমি চাষ করার অধিকার পাবে। সব ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হবে। বলদ চালিত লাঙলের ওপর দু’পয়সা আর মহিষ চালিত লাঙলের ওপর দু’আনা খাজনা ধার্য হবে।
এই বিদ্রোহের সময় স্থানীয় কামার-কুমার, তেলী, চামার, ডোম ও মুসলমান তাঁতিরা সাঁওতালদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল। বিদ্রোহীরা বাংলা, বিহার ও ছোট নাগপুরের কয়েকটি অঞ্চলে ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করেছিল এবং নিজেদের শাসন ছ’মাস কালব্যাপী পরিচালনা করেছিল। আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহে প্রতিবাদী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল প্রাণ বিসর্জন দেন। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুক যুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ ও ভৈরব নিহত হয়। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ বাহিনী সিধুকে ধরে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিধু, কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন । সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎসই ছিল না, বরঞ্চ স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরবর্তীতে উজ্জীবিত করেছিল ।।