একদিকে যখন “পুষ্পা ২” ছবি বক্স অফিসের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে,গোটা বিশ্বজুড়ে অপ্রশংসিত হচ্ছে, অন্যদিকে বেঙ্গালুরুতে তেলুগু অভিনেতা আল্লু অর্জুনের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায় কংগ্রসের দুর্বৃত্তরা । কংগ্রেস শাসিত তেলেঙ্গানায় আল্লু অর্জুনের ছবি নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি তুলছে শাসকদলের নেতাকর্মীরা ৷ অভিনেতার অপরাধ শুধু কংগ্রেসের সমর্থনে ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেননি । আর এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ৪৯ বছর আগে বলিউডের স্বনামধন্য কন্ঠশিল্পি কিশোর কুমারের উপর কংগ্রেসের প্রতিহিংসার কাহিনী ।
ব্যাতিক্রমী ও অনন্য কণ্ঠের অধিকারী এই গায়ক তথা অভিনেতা কিশোর কুমার মাত্র ৫৮ বছরের জীবনে জয় করে নিয়েছিলেন অগণিত শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগে নিষিদ্ধ হতে হয়েছিল তাঁকে । আর নিষিদ্ধ করেছিলেন ইন্দিরা-ফিরোজ খানের কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় । কিন্তু কেন ? জানুন সেই কাহিনী :
কিশোর কুমারকে কংগ্রেসের প্রস্তাব
ভারতে তখন জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। সংবিধান স্থগিত, রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত। সেই সময় যুব কংগ্রেসের একটি পদযাত্রায় কিশোরকে বিনা পারিশ্রমিকে গান গাইতে অনুরোধ করেন ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। কিন্তু একজন পেশাদার শিল্পি হওয়ায় কিশোর কুমার গান গাইতে রাজি হননি । পাশাপাশি
তিনি ভাবলেন, একজন শিল্পী হিসেবে এভাবে একটি দলের পরিচয় বহন করা ঠিক হবে না। তাই অনুপস্থিত থাকলেন। এতে গান্ধী পরিবারের অঘোষিত যুবরাজ সঞ্জয় চরম ক্ষুব্ধ হয় ।
২০ দফার পক্ষে প্রচারণায় যেতে ও গান গাইতে অস্বীকার
যুব কংগ্রেসের পদযাত্রায় তো কিশোর হাঁটলেন না। এরপর তার কাছে এলো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যা চরণ শুক্লা সে সময় কংগ্রেসের পক্ষে ২০ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রচার শুরু করেন। এই দফাগুলো এসেছিল মূলত সঞ্জয় গান্ধীর মাথা থেকে। বলিউড তখন সাধারণ জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায়। সে সময়ের শীর্ষ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাই এই কর্মসূচি উপলক্ষে নির্মিত হতে চলা বিজ্ঞাপনচিত্রের গানটি গাইবার প্রস্তাব পান কিশোর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সে সময়কার যুগ্মসচিব সি বি জৈন কিশোর কুমারকে টেলিফোন করে তার বাড়িতে একদল সচিবসমেত আসতে চান। কিশোর গানটি গাইতে চান না বলে ফোন রেখে দেন।
কিশোরকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ
কিশোরের এই প্রত্যাখানের খবর চলে যায় মুখ্য সচিব এস এম এইচ বার্নির কাছে। বার্নি বিদ্যা চরণ শুক্লার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। এরপরই কিশোর কুমারকে রাষ্ট্রীয় সব গণমাধ্যম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলতে ছিলো শুধু দূরদর্শন ও আকাশবাণী। দুটি মাধ্যম থেকেই নিষিদ্ধ হওয়ায় ব্রডকাস্টিং মিডিয়া থেকে পুরোপুরি আড়াল হয়ে যান কিশোর কুমার । তাকে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে নিতেও বাধা দেওয়া হয় প্রযোজক ও সঙ্গীত পরিচালকদের। তার গ্রামোফোন রেকর্ড বাজার থেকে অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় তুলে নেওয়া হতে থাকে।
জরুরি অবস্থার অবসান ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
কিশোরকে নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক প্রযোজকই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কংগ্রেসকে চাপ দিতে থাকেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। সাংবাদিক রঞ্জন দাশগুপ্তর সাথে আলাপচারিতায় মান্না দে বলেছিলেন, ‘রফি (মোহাম্মদ রফি) সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে বলেছিল যে, জওহরলাল নেহরুর নাতি হয়ে আপনি কী করে কিশোরের মত শিল্পীকে নিষিদ্ধ করতে পারলেন?’
এদিকে, ১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্যারোলে মুক্তির ৫ দিন পর নাট্যকর্মী, নির্দেশক ও অ্যাক্টিভিস্ট স্নেহলতা রেড্ডির মৃত্যু হয়। তিনি নিজেও জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং কারাগারে অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হন। তার মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ তৈরি হয়। সত্যজিৎ রায় জওহরলাল নেহরুর ওপর তথ্যচিত্র বানাতে অস্বীকার করেন। দেব আনন্দ ও তার ২ ভাই (চেতন ও বিজয়), উৎপল দত্ত, মনোজ কুমার, প্রাণ, উত্তম কুমার, হৃষিকেশ মুখার্জি, সলিল চৌধুরীসহ অনেকেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
পরবর্তীতে কংগ্রেস জরুরি অবস্থা বাতিল করে ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভরাডুবির মধ্য দিয়ে তাদের একটানা ৩০ বছরের শাসনের অবসান হয়। এরপর কিশোর কুমারের ওপর আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীতে জনতা দলের মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হলে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। জাস্টিস জে সি শাহের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের কাছে বিদ্যা চরণ শুক্লা স্বীকার করেছিলেন—এসব মূলত তার ও সঞ্জয়ের ইচ্ছাতেই ঘটেছিল। এটি একজন শিল্পীর প্রতি অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায্য আচরণ বলে তিনি একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে এই নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর আবার দূরদর্শনে দেখা যায় দুরন্ত কিশোর কুমারকে, আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয় তার গান। পরবর্তীতে আমৃত্যু প্লেব্যাকে-কনসার্টে শীর্ষে ছিলেন এই মহান শিল্পি ।
বেঁচে থাকলে আজ ৯৭ বছরে পা রাখতেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী কিশোর কুমার। ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খান্দোয়ায় আইনজীবী কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও গৃহিণী গৌরী দেবীর ঘরে জন্ম হয় কিশোরের। তার জন্মনাম ছিলো আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়।।