আমার রাশভারী বাবাকে নিয়ে কখনো কিছু লেখা হয়নি। আসলে লেখার সাহস হয়নি। বাবার জীবন দর্শনের উচ্চতায় পৌঁছতে, আর বাবাকে বুঝতে অনেকটাই সময় পার করে ফেলেছি। এখন বয়েসের ভার যত বাড়ছে, হঠাৎ করেই খেয়াল হলো আমাদের বাবা, কাকা, জ্যাঠারা কবে যেন বার্ধক্যের সীমায় পা রেখে দিয়েছেন। হাতের মুঠোয় যেমন জল ধরে রাখা যায়না বেশিক্ষন, তেমনই আঙুলের ফাঁক-ফোকর গলে সময়ের জল গড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
আজকাল বড্ড ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে। নিজের ঘরে। আমার আশৈশব বেড়ে ওঠা ওই রোদ ঝলমলে উঠোনটায় ফিরতে ইচ্ছে করে। বাবার কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। গ্রামকে আর নিজের পৈতৃক ভিটেটাকে ভালোবেসে বাবা আজীবন গ্রামেই থেকে গেলেন। কতটা সাধারণ ভাবে জীবন কাটানো যায় সেটা আমার বাবাকে না দেখলে আর আমাদের বাড়ি না গেলে কেউ বিশ্বাস করবেনা। আমরা হাজার চেষ্টা করেও বাবাকে আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত করাতে পারিনি। মুখে রাগ দেখালেও ভেতরে ভেতরে বাবাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব হয় আমার। প্রায় আটত্রিশ বছরের পুরোনো একটা হারকিউলিস সাইকেল নিয়ে বাবা এখনো গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। গ্রামের সবার খোঁজ খবর নিয়ে বেড়ায়। বাকি সময়টা বইপত্র, রাশি রাশি পত্র পত্রিকা, আর গাছপালা নিয়ে কাটিয়ে দেয় মানুষটা। বাবার এই অতি সাধারণ জীবনটার কাছে বারবার ফিরতে ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু আমার কর্মজীবন সেই ইচ্ছের সামনে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাবার মতো আমিও আমার গ্রামটাকে ভীষণ ভালোবাসি কিন্তু কখনো তার জন্য কিছু করার সুযোগ হয়নি। বহুদিন বাদে নিজের শিকড়ের কাছে ফেরার একটা সুযোগ পেয়েছিলাম – একটা ভালো কাজের হাত ধরে। একটা ‘ভালো কাজ’এর চারাগাছ সযত্নে রোপণ করতে চেয়েছিলাম আমি ও আমার মতো আরও অনেকে মিলে, যারা নিজের শিকড়ের কাছে ফিরতে চান। গ্রামের মানুষের আদর যত্নে একদিন সেই চারাগাছ মহীরুহ হয়ে সবাইকে শীতল ছায়া আর সুবাতাস বিলোবে এই ভরসায়। কিন্তু চারপাশে যেখানে হাওয়ায় শুধুই বিষ, সেখানে এই কাজ যে সহজ হবেনা তা যেন আমরা জেনেও ঠিক মানতে পারিনি।
কোনো ভালো কাজের পথে বারবার বাধা বিপত্তি এলে বুঝতে হবে সবাই সঠিক পথেই আছি। এই পথই আমাদের একদিন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে – আজ নাহোক কাল। আমাদের পারতেই হবে। নাহলে যে আর আমার মতো বহু মানুষের তাদের বাবাদের কাছে, বাবাদের জীবনের কাছে ফেরা হবেনা কোনোদিনই ।।