কোথায় যেন একটা ঠক ঠক আওয়াজ ভেসে আসছে।
কাব্য, তুমি কি এলে?
উফফ, কেউ কথা বলছ না কেন তোমরা?
আমার কথার কোনো জবাব দিচ্ছ না কেন কেউ?
অনিকেত, তুমি এসেছ?
শোন না, আলমারিতে আমার শাড়ি গুলোর পাশে তোমার দেওয়া ওই গ্রিটিংস কার্ডগুলো, গোটাকয়েক শুকিয়ে যাওয়া গোলাপফুল, আমাদের প্রেমের প্রথম দিকে তোমার কিনে দেওয়া ক্যাডবেরীর ছেঁড়া প্যাকেটগুলো আজও ভীষণ যত্ন করে রাখা আছে।
আবর্জনা বলে কতবার তুমি ওগুলো ফেলে দিতে চেয়েছ, আমিই বাধা দিয়ে আগলে রেখে এসেছি এতকাল। আজ মুক্তি দিতে ইচ্ছে করছে খুব।
তুমি একটু এসো, এসো না গো। যা কিছু তুমি জঙ্গল ভেবে, অতিরিক্ত ভেবে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছ, সরিয়েই তো দিয়েছ। এসো, আজ এগুলিও মুছে দিয়ে যাও, স্মৃতির ভার থেকে আমিও এবার মুক্তি পেতে চাই।
তোমার ভালোবাসার ঘরে আমি বড্ড বেমানান, সেটা তুমি বুঝতে পেরেছিলে আমাদের বিয়ের চার বছর পর। আমি মেনে নিয়েছিলাম।
কাব্যকে তোমার ছায়ায় রাখা সম্ভব নয়, মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি অন্যের সংসারের গৃহকর্তা হওয়ার পরও আমি সব কিছু কি করে মেনে নিতাম, বলো? তাই তোমায় মুক্তি দিয়েছি।
কিন্তু মনের মায়ার, পিছুটানের মুক্তি দিতে পারলাম কই এজীবনে!তোমার ভালোবাসায় ঘাটতি সয়ে গেলাম মুখ বুজে, শুধু প্রতারণাটা সইতে পারলাম না মন থেকে। আসলে আত্মসম্মানটা যে প্রখর ছিল! আজও অবশ্য তেমনিই আছি।
মিথ্যে মায়ায় জড়ানো এই প্রাণটা ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমি কিছু প্রশ্ন রেখেছি লিখে, এই যে এখানে, আমার মনের অলিতে গলিতে, রান্নাঘরের নুন-লঙ্কার কৌটোতে, সাজিয়ে রাখা কিছু পুরনো কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে, দ্বিরাগমনে তোলা ওই যুগল ছবির ফোটো ফ্রেমে, খাটের কোনার ওই দম ফুরিয়ে যাওয়া টেবিল ল্যাম্পটায়, কত প্রশ্ন আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, থরে থরে, শুনবে?
তুমি এসো, এসে দেখে যাও, উত্তর দিয়ে যাও আমায়, ত্যাগ মানে কি? বিশ্বাস মানে কি ভালোবাসা মানেই বা কি?
আর সব শেষে প্রতারনার অর্থ নাহয় আমিই বলব।
কাব্য, তোমার ঘরের কোনায় যে ভাঙা এক্কাগাড়িটা আছে, ওটা তোমার প্রথম খেলনা ছিল। বইয়ের তাকে ঐ বাক্সটার ভেতর দেখ, কাটাকুটি করা কয়েকটা হলদে পাতার কাগজ জমানো আছে। ওসব তোমার প্রথম অক্ষর জ্ঞানের পরিচয়ের টুকরো টুকরো স্মৃতি, পাশের ওই পুরনো ডাইরিতে লেখা তোমার প্রথম ‘মা’ বলে ডেকে ওঠার সময়-তারিখ।
ওখানেই খুঁজে দেখ তুমি, আরও অনেক কিছু পাবে। যেমন প্রথম দাঁত ওঠা থেকে হামাগুড়ি দেওয়া, দেওয়াল ধরে দাঁড়ানো থেকে সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে যাওয়া… সবকিছুর সময় তারিখ মাস বছর সব… সবটাই যত্ন করে লিপিবদ্ধ করা আছে।
এমনকি আমাকে ছাড়াই তোমার নতুন সংসারে পদার্পণের গল্পটাও অল্পবিস্তর লিখে রেখেছিলাম। মাকে জড়িয়ে বেঁচে ওঠা যায়, বেড়ে ওঠা যায়, শুধু মাকে জানিয়ে নিজের সংসারটা আলাদা করা যায়না কেন তার উত্তরটা লিখে উঠতে পারি নি।
সময় ফুরিয়ে গেলে মাকে মা বলা যায় না কেন জেনে উঠতে পারি নি, তাই বোধহয় আর লেখাও হয় নি ওসব!
সেসব না হয় ঠিক আছে। জমিয়ে সংসার করার লোভ সবারই থাকে। আমারও ছিল, তোমাদেরও থাকবে , সেটাই স্বাভাবিক। জীবনে এত কিছু মেনে নিলাম, মানিয়ে নিলাম, এটা মেনে নিতে পারতাম না বুঝি? তাহলে? তাহলে এত মিথ্যের আশ্রয় নিতে হল কেন কাব্য তোমায়? চোখ চুরি করে, মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যেতে হল কেন তোমায়।
তোমার সুখ কিনতে গিয়ে আমাকে সাগরের নোনা জলে ভাসতে হল কেন? তোমাকেই বা মা মানুষটাকে অস্বীকার করতে হল কেন? অনেক প্রশ্ন জমে আছে পাতায় পাতায়, কে দেবে তার উত্তর!
কাব্য, তুমি এসেছ?
বলার তো আমারও অনেক কিছু আছে তোমায়, অনেক কিছু!
অপেক্ষা কি, আপনকে হারাবার কষ্ট কি, বুকে পাথর চাপিয়ে আবেগের গলা টিপে কি করে হাসি মুখে আত্মজনের সমস্ত আবদারকে মেনে নিতে হয়।
কাব্য তুমি কি এলে? অনিকেত, তুমি?
উফফ, বড্ড কষ্ট, শ্বাস নিতে পারছি না যে আর, বুকের মাঝে চাপ চাপ বেদনার কালো মেঘ গুলো ঝরে যাক, একটু বাতাস দেবে আমায়, একটু উষ্ণ আদর।
কান্নার অশ্রু জমতে জমতে বরফের চাঁই হয়ে গেছে। একটু আগুন দাও না কেউ, একটু শক্ত করে ধরো আমায়। আমি ফুরোবার আগে একটু আঁকড়ে ধরতে চাই, ঠান্ডা বাতাস হয়ে ছুঁয়ে যেতে চাই তোমাদের তপ্ত দাওয়া, বাড়িয়ে দাও তোমাদের হাত, ধরো, একটুখানি আপন করে নাও, একবার একটু জড়িয়ে ধরতে দাও আমার বিশ্বাসটাকে, আঁকড়ে ধরতে দাও অপেক্ষাকে, জিতে যেতে দাও আমার নিঃশর্ত ভালোবাসাকে।
একটা জীবন পুরোটাই কেন ভুল হবে! সবসময় হেরে যেতে হবে কেন শুধু একজনকেই!
একবার এসো, ফিরে এসো….কাব্য… অনিকেত… তোমাদের ফেলে যাওয়া অতীতের কাছে একবার অন্তত ফিরে এসো তোমরা, আমি যে ফুরিয়ে যাচ্ছি গো…. আমি যে ফুরিয়ে যাচ্ছি ।।