জয়দীপ মৈত্র,দক্ষিণ দিনাজপুর,২৪ ফেব্রুয়ারী : ইচ্ছা থাকলে কোন প্রতিবন্ধকতাই স্বপ্নপূরণে বাধা হতে পারে না । একথা প্রমাণ করে দিলেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরের বাসিন্দা রিন্টু মালি । পরিবারে সীমাহীন অভাব । জাতীয় সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান । সেই উপার্জন থেকেই বাবা মাকে নিয়ে তিন সদস্যের পরিবারের দুই বেলার কোনও রকমে অন্ন সংস্থান । তবু হার মানেননি । কারন তাঁর দু’চোখে তখন বাবা-মায়ের দুঃখ কষ্ট দূর করার স্বপ্ন । তাঁদের একটা ছোট্ট পাকা বাড়ি আর সম্মানজনক জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া রিন্টু । আর এই স্বপ্নই বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর জেদকে । দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছেন যাবতীয় প্রতিকুলতার সঙ্গে । শেষ পর্যন্ত অদম্য জেদ আর দু’চোখ ভরা স্বপ্নই এনে দিল সাফল্য ।
গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারী নিট (National Eligibility Cum Entrance Test) পরীক্ষায় বসেছিলেন রিন্টু । চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারী তার ফলাফল প্রকাশ হয় । দেখা যায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন মেডিকেলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় । মালদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন রিন্টু মালি । অভাবের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে তাঁর হার না মানা এই কাহিনী আজ মুখে মুখে ফিরছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা জুড়ে ।
বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান রিন্টু মালি । জাতীয় সড়কের পাশে পূর্ত দপ্তরের জায়গায় ঝুপড়িতে তাঁরা বসবাস করতেন । সেখানেই জন্ম রিন্টুর । প্রথমে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল, পরে বুনিয়াদপুর হাই স্কুলে তাঁর পড়াশোনা । কিন্তু ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময়েই দুর্দৈব নেমে আসে রিন্টুর জীবনে । ওই বছর কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সভার কারণে পৌরসভার পক্ষ থেকে তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় । ভেঙে ফেলা হয় একমাত্র আশ্রয়স্থলটি । ফলে গৃহহীন হয়ে পড়ে গোটা পরিবার । মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে রিন্টুর । আর এই অবস্থায় অসহায় ওই পরিবারটিকে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় দিয়েছিলেন গৌরাঙ্গ মহন্ত নামে স্থানীয় বাসিন্দা । তারপর একাধিক বাড়ির আশ্রয়ে কাটিয়ে শেষে বাবা-মাকে নিয়ে রেলের জায়গায় বসবাস শুরু করেন রিন্টু । করগেটের ছাউনি আর করগেট দিয়ে ঘেরা ঝুপড়ি ঘরে বর্তমানে তাঁরা বসবাস করছেন । জীবনের এত ঘাত প্রতিঘাত সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন আজন্ম মেধাবী ওই পড়ুয়া ।
অতীতের সংগ্রামের জীবন বর্ণনা দিতে গিয়ে দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে রিন্টুর । কোনও রকমে নিজেকে সংযত করে তিনি বলেন, ‘এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কখনও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিনি । নিজেকে কখনও দূর্বল ভাবিনি । কারন আমি দূর্বল হলেই বাবা-মাও তখন ভেঙে পড়তেন । তাই কান্না আড়াল করে জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে গেছি । এখন লক্ষ্য বাবা-মায়ের জন্য একটা স্থায়ী আশ্রয়স্থল নির্মান করা আর সম্মানজনক জীবন দেওয়া ।’
তবে জন্মগত মেধা আর আর্থিক অসঙ্গতির কারনে সকল শিক্ষক শিক্ষিকার প্রিয়পাত্র ছিলেন রিন্টু । কেয়া ম্যাডাম আর সুজিত স্যারের মত শিক্ষকেরা তাঁকে বিনা বেতনে পড়িয়ে গেছেন । এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা গৌরাঙ্গবাবু,পার্থবাবুরা বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত । তাঁদের সকলকে আন্তরিকতাভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রিন্টু । তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘ওনাদের সহৃদয়তায় আমার মনোবল বাড়াতে অনেক সাহায্য করেছে । ওই ঋণ শোধ করতে পারবো না কখনও । বুনিয়াদপুরের মানুষ আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন । তাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমি এলাকাবাসীর জন্য কিছু করতে চাই ।’ ছেলের সাফল্যে গরবিনী মা মীরা মন্ডল মালি বলেন, ‘ছোট থেকে দেশের সেবা করা আমার খুব ইচ্ছা ছিল । কিন্তু কোনও কারন বশত দেশের জন্য আমি কিছু করতে পারিনি । সেই অপূর্ণ ইচ্ছা আমার ছেলে পূর্ণ করুক সেটাই চাই ।’।