কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুনী চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের জেরে এমনিতেই ব্যাকফুটে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । এই মামলায় কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে উঠছে একাধিক গুরুতর অভিযোগ । প্রমান লোপাটের অভিযোগ তুলে কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে গ্রেফতারের দাবিতে সরব হয়েছে বিজেপি । এমনকি খোদ তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বিনীত গোয়েলকে সিবিআইয়ের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি তুলেছেন । প্রকাশ্যে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পদত্যাগেরও দাবি উঠছে । পুলিশ একের পর এক আইনি নোটিশ পাঠিয়েও নেটিজেনদের আরজি কর ধর্ষণ-হত্যাকান্ড নিয়ে পোস্ট করা বন্ধ করতে পারছে না।
এই পরিস্থিতিতে আরজি কর কান্ডে প্রতিবাদীদের তৃণমূলের হুমকি এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা তৃণমূলের রাজ্য সহ সভাপতি উদয়ন গুহ ও অরূপ চক্রবর্তী,খোকন দাসেদের মত তৃণমূল বিধায়ক এবং কল্যাণ ব্যানার্জির মত সাংসদদের অপ্রীতিকর মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে ।
উদয়ন গুহ কখনো মন্তব্য করছেন,’মরা মানুষের জন্য আন্দোলন করা হচ্ছে আর যাঁরা বেঁচে রয়েছেন তাঁদের জন্য তাহলে কী হবে ।’ কখনো তিনি মহিলা আন্দোলনকারীদের নিয়ে কটাক্ষ করে বলছেন, ‘স্বামীরা মারলে রাতে যেন কোনও মহিলা ফোন করে আমার কাছ থেকে সাহায্য না চায়।’ এছাড়া তাকে বলতে শোনা যায়,’মদের ঠেক, জুয়ার বিরুদ্ধে শহরের জিন্স পরা মহিলারা কখনও মাঠে নামেন না। কারণ, আবেগ কম পড়ে যায়।’ আর এক কদম এগিয়ে উদয়ন আন্দোলনকারীদের হুমকি দিয়ে বলেন,’যারা আঙুল তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাইছে, সেগিলোকে চিহ্নিত করে, সেই আঙুলগুলোকেও ভেঙে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। নাহলে পরে এরা বাংলাকে একটা নতুন করে বাংলাদেশ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ওরা জানে না, হাসিনা যে ভুল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভুল করবে না, করেনি। তাই আরজি করে ওইভাবে ভাঙচুর করার পরেও পুলিশ কিন্তু গুলি চালায়নি, পুলিশ এখানে বাংলাদেশ করতে দেবে না।’
আর এ বার বিরোধীদের হাতটাই মুচড়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেন বাঁকুড়ার তৃণমূল সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী। রবিবার আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে তৃণমূলের একটি প্রতিবাদ মিছিলে অরূপ বলেছেন,’মুখ্যমন্ত্রীর গায়ে কালি ছেটানোর চেষ্টা হলে হাত মুচড়ে দেবে তৃণমূল কর্মীরা।’ একই সঙ্গে আরজি কর আন্দোলনে পুলিশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্যও করতে শোনা গিয়েছে অরূপকে। বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক খোকন দাস বলছেন,’আমরা জানি ওরা অশান্তি করতে চাইছে। তাই চুপ করে আছি। আমরা অশান্তি করলে ওরা থাকবে কোথায় ?’ প্রসঙ্গত, এই খোকন দাস কয়েক বছর আগে প্রকাশ্য সভায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় পরিচয়পত্র করে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ।
পাশাপাশি বিতর্কিত মন্তব্য করতে অভ্যস্ত এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ খনড়ককে নিয়ে ভাঁড়ামি করা শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জিকেও আন্দোলকারীদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গেছে । কল্যান বলেছেন,’অনেক কিছু গালাগাল দিচ্ছেন। সামলাতে পারবেন তো? ভাবলেন গান করে আর স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে পশ্চিমবাংলা থেকে মমতা ব্যানার্জিকে উৎখাত করে দেব? অত সহজ নয়, অত সহজে হবে না।’ এদিকে বিজেপি নেতা অমিত মালব্য একটা অডিও রেকর্ড এক্স-এ পোস্ট করেছেন ৷ অডিওতে কলকাতার বাসিন্দা জনৈক এক মহিলা দাবি করেছেন যে আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুনী চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের ঘটনায় আয়োজিত মোমবাতি মিছিলে সামিল হওয়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তাকে হুমকি দিয়ে গেছে ।
কিন্তু যে বাংলাদেশের ঘটনার কথা তুলে তৃণমূলের নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলমান ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের প্রতিবাদী আন্দোলনের অনেকাংশেই মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে । বাংলাদেশের কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল রাজধানী শহর ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলি থেকে । ক্রমে তা গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে । আন্দোলন দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের ক্যাডাররাও হাতে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল ।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনাক্রম নজরে পড়ছে । আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুনী চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন ওই মেডিকেল কলেজের পড়ুয়ারাই । যদিও এই আন্দোলন এখনো পর্যন্ত চলছে শান্তিপূর্ণ ভাবেই । সেই কারনে পুলিশকে গুলিও চালাতে হয়নি । আওয়ামী লীগের মত তৃণমূলের ক্যাডাররা এখনো আন্দোলন প্রতিহত করতে রাস্তায় নামেনি । তবে মেডিকেল কলেজে হামলার ঘটনাটা তৃণমূলের দ্বারাই সংগঠিত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠছে । কিন্তু রাস্তায় নেমে আন্দোলন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাগাতার প্রচারে তীব্র মনস্তাত্ত্বিক চাপে রয়েছে শাসকদল । আর সেই চাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তৃণমূলের মন্ত্রী,সাংসদ ও বিধায়কদের আচরণ ও কথাবার্তায় । তবে তাদের লাগামহীন মন্তব্যে জনমানসে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে,যার জেরে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিতে পারে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল ।।