প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৪ মার্চ : দোল পূর্ণিমার দিন সারা বাংলা মাতোয়ারা থাকে রঙের উৎসবে।কিন্তু সুপ্রাচীন ঐতিহ্য মেনে এই দিনটিতে আবিরের রঙে রাঙা হন না রাঢ়বঙ্গের অন্যতম প্রাচীন নগর বর্ধমানের বাসিন্দারা।এখানে রঙের উৎসব পালিত হয় দোল পূর্ণিমার পরের দিন ।রাজা না থাকলেও শতাব্দী প্রাচীন কাল ধরে রাজরীতি মেনে এই ভাবেই রঙের উৎসব পালন করে চলেছেন বর্ধমানবাসী।একই রকম ভাবে সাবেকী রীতিমেনে এই জেলার জামালপুর ব্লকের ’রাধাবল্লভবাটি’ মৌজার বাসিন্দারাও দোলের দিন আবিরের রঙে রাঙা হন না।দোল পূর্ণিমার পরদিন এই এলাকায় পালিত হয় দোল উৎসব । যা ’জোড়া রাধাবল্লভের’ দোল নামেই খ্যাত ।
দোল পূর্ণিমার দিন বর্ধমানবাসীর রঙের উৎসবে মাতোয়ারা না হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে দেবতাদের প্রতি ভক্তির এক কাহিনী।কথিত আছে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহতাব এই প্রথা চালু করেন ।পঞ্জিকা মতে দোল পূর্ণিমার দিনটিকে বর্ধমানের অধিষ্টাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা দেবীর দোল হিসাবে মানা হয়। এও কথিত আছে বর্ধমানে দোল পূর্ণিমা তিথিটি হল ঠাকুর দেবতার দোল উৎসবের দিন। সেদিন শুধুমাত্র দেব-দেবীর রাঙা চরণ আবির ও কুমকুমে চর্চিত হবে।সেই উপলক্ষে রাজবাড়ির অন্দর মহলে দোল খেলা হয়ে থাকে।পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় বর্ধমানে মানব সাধারণের রঙের উৎসব। আজও সেই রীতির সার্থক উত্তরাধিকারী বর্ধমানের মানুষ । ঐতিহ্য মেনে আজও দোল পূর্ণিমা তিথিতে প্রাচীন বর্ধমানের প্রানকেন্দ্র সর্ব্বমঙ্গলা বাড়িতে দোল উৎসব পালিত হয় এবং বর্ধমানবাসী পরের দিন দোল উৎসব পালন করেন ।
রাজ আমলের ঐতিহ্যে মোড়া বর্ধমানের রঙের উৎসবেকে আরও রঙিন করে তুলতে এবছর আশরে অবতীর্ণ হয়েছেন মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা । শহর বর্ধমানের বি সি রোড এলাকায় থাকা শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টির দোকানে এখন শোভা পাচ্ছে রঙ্গিলা রসগোল্লা,রঙ্গিলা সন্দেশ,রঙ্গিলা পোলাও সহ হরেক রকম রঙিন মিষ্টি।। এছাড়া নানা রঙের রসগোল্লা,সন্দেশ তো রয়েইছে।বর্ধমান শহরে দু’দিনের দোল উৎসব অর্থাৎ রঙের উৎসব পালিত হয়।সেই উৎসবের দিকে তাকিয়েই রঙ্গিলা মিষ্টি তৈরির ভাবনা বলে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সৌমেন দাস জানিয়েছেন।
বর্ধমানের মতই একই রকম ঐতিহ্য মেনে দোল পূর্ণিমা তিথি কাটলে ’জোড়া রাধাবল্লভের’ দোল উৎসবে মাতোয়ারা হন পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের রাধাবল্লভবাটি মৌজা এলাকার বাসিন্দারা।দীর্ঘ প্রায় চার শতাধীক বছর ধরে জোড়া রাধাবল্লভ পূজিত হয়ে আসছেন জামালপুরের রায় পরিবারের মন্দিরে।রাধাবল্লভের চরণে আবির দিয়ে তারপর বিকালে জামালপুরবাসী রঙের উৎসবে মাতোয়ারা হবেন।ওইদিন মন্দির প্রাঙ্গনে বসে মেলা। জোড়া রাধাবল্লভের পুজো দেখতে আশপাস এলাকার বহু মানুষ ওইদিন মন্দির প্রাঙ্গনে জড়ো হন । জেলায় আজও অন্যতম ঐতিহ্যের সাক্ষ বহন করেচলেছে জোড়া রাধাবল্লভের দোল উৎসব ।
জোড়া রাধাবল্লভের দোল উৎসব নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা লোককথা।জামালপুরের রায় পরিবারের সদস্য প্রশান্ত রায় জানান , “তাঁদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন রাজপুত । প্রায় চার শতাধিক বছর কাল আগে রাজস্থান থেকে বর্ধমানে বানিজ্য করতে এসেছিলেন রাজপুত সিংহ বংশিয় তাঁদের এক পূর্ব পুরুষ।অবিভক্ত বর্ধমান জেলার জামালপুরে তিনি আস্তানা গাড়েন । শত্রু আক্রমণ ঠেকাতে গড়কাটা হয় আস্তানার চারপাশ জুড়ে । সেই গড়কাটার সময় মাটি থেকে উদ্ধার হয় রাধাকৃষ্ণের অষ্টধাতুর একটি মূর্তি । রাধাকৃষ্ণ মূর্তিটি রাজপুত পরিবারের কাছে রাধাবল্লভ নামে পরিচিতি পায় । আস্তানা এলাকায় ছোট্ট একটি মন্দির গড়ে রাধাবল্লভের মূর্তির পুজোপাঠ শুরু করেন তদানিন্তন রাজপুত পরিবারের সদস্যরা । সেই সমসাময়িক কালেই কোন এক বৈষ্ণব সাধক ওই মন্দিরের সামনে কষ্টিপাথরের একটি কৃষ্ণ মূর্তি এবং অষ্ট ধাতুর একটি রাধা মূর্তি ফেলে রেখে দিয়ে চলে যান ।সেই থেকেই দোল পূর্ণিমা তথি পরবর্তীতে প্রতিপদ তিথিতে জোড়া রাধাবল্লভের মূর্তির পুজোপাঠ হয়ে আসছে রাধাবল্লভ মন্দিরে ।
প্রশান্ত বাবু আরও জানান,পূর্বতন বর্ধমান মহারাজা জামালপুরের কয়েকটি মৌজা এলাকার জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদের পূর্ব পুরুষদের।সেই সময় কালেই রাধাবল্লভ কে স্মরণ করে এখানকার জমিদারি মৌজা রাধাবল্লভবাটি মৌজা নামে পরিচিতি পায় । বর্ধমান মহারাজা কর্তৃক রায় উপাধিতে ভূষিত হয় রাজস্থান থেকে জামালপুরে আস্তানা গাড়া সিংহ পরিবার। ভক্তিতে ভর করেই জোড়া রাধাবল্লভের দোল উৎসবের দিনেই রঙের উৎসবে মাতেন জামালপুরের রাধাবল্লভবাটি মৌজার বাসিন্দারা ।
রায় পরিবারের অপর সদস্য পার্থপ্রতিম রায় জানালেন,’দোল পূর্ণিমার দিন রাধাবল্লভ মন্দির প্রাঙ্গনে পরিবারের সকল সদস্য মিলে চাঁচর পোড়ান । পূর্ণিমা কাটলে প্রতিপদ তিথিতে বংশের মন্দিরে হয় রাধা বল্লভের পুজোপাঠ। রাধাবল্লভের ভোগ অন্নে শুক্তো থাকতেই হবে। পুজোপাঠ শেষে রাধাবল্লভের চরণে আবির দিয়ে বিকালে মন্দির চত্ত্বরে এলাকাবাসী আবির খেলায় মাতেন । সন্ধ্যায় বিতরণ করা হয় অন্ন ভোগ ।।