এইদিন ওয়েবডেস্ক,২১ এপ্রিল : শক,হুন,পাঠান,মুঘল, ইংরেজ -একের পর এক বিদেশী হানাদারের আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ভারত ৷ ভারতে বীর যোদ্ধা কম ছিল না । তবুও দেশকে হাজার বছর বিদেশী হানাদারের গোলামী করতে হয়েছে । আর এর জন্য দায়ী বিদেশি হানাদার নয়,বরঞ্চ ভারতের তৎকালীন রাজাদের ঈর্ষাপরায়ণতা,লোভ,অদুরদর্শিতা, দেশাত্মবোধের অভাব এবং অনেকাংশে চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব । বিদেশি হানাদারের বিরুদ্ধে কোনো রাজা লড়াই করতে চাইলে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজার কোনো প্রকার সহযোগিতা তো দূর,বরঞ্চ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হত । মুঘল বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আক্রমণের সময় ভারতের রাজা বা জমিদারদের মধ্যে ‘এক জাতি’র চিন্তার কোনো চিহ্নই ছিল না ভারতে । আমাদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের সাথে আমরা কেমন আচরণ করেছি তা ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ ও তাঁর একমাত্র দত্তক সন্তান দামোদর রাও এর জীবন কাহিনীর প্রতি চোখ রাখলেন বুঝতে পারবেন ।
১৮৩৫ সালে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রানী লক্ষ্মীবাঈ । ছোটবেলায় তার নাম ছিল মণিকর্ণিকা । লক্ষীবাঈয়ের যখন সাত বছর বয়স তখন উত্তর প্রদেশের ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-এর সঙ্গে বিবাহ হয় তার । বিবাহের নয় বছর পর তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন । কিন্তু মাত্র চার মাসের মাথায় সে পুত্র সন্তান মারা যায় । ছেলের মৃত্যুর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজা গঙ্গাধর রাও । শেষের রানী লক্ষ্মীবাঈ এক নিকট আত্মীয়ের ছেলেকে দত্তক নেন । তার নাম রাখা হয় দামোদর রাও (আসল নাম আনন্দ রাও) । কিন্তু এরপরেও রাজা গঙ্গাধর রাও-এর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে । অবশেষে ১৮৫৩ সালে রাজা গঙ্গাধর রাও মারা যান ।
এদিকে তখন ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । গঙ্গাধর রাও মারা যাওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজর পরে ঝাঁসির ওপর । শেষে রাজ্যের শাসনভাগ নিজের হাতে তুলে নেন রানী লক্ষ্মীবাঈ । এদিকে ইংরেজরা এক নতুন আইন নিয়ে আসে । যার নাম ছিল স্বত্ববিলোপ নীতি । সেই আইন অনুযায়ী যে রাজাদের নিজের ঔরসজাত কোন পুত্র সন্তান নেই তাদের রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে আসবে । আর এ নিয়েই বিবাদ শুরু হয় রানী লক্ষ্মীবাঈ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে । রাণী তাঁর রাজ্য এবং কেল্লা ছাড়তে অস্বীকার করেন । তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উত্তর প্রদেশের বাঙ্গিরা নামক একটি বড় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ঝাঁসির কেল্লা আক্রমণ করে ।
এই যুদ্ধে রানীর তিনজন প্রিয় যোদ্ধা গোলাম গোস্ত খান, মতি বাঈ এবং খোদাবক্স মারা যান । রাণীর নির্দেশে তাদের তিনজনকেই কেল্লার ভিতরে সমাধিস্থ করা হয় । যোদ্ধার মৃত্যুর পর রানী লক্ষ্মীবাঈ তার দত্তক সন্তান দামোদর রাওকে পিঠে বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে কেল্লার ছাদ থেকে প্রায় ৩০-৪০ ফুট নিচে লাফিয়ে পালিয়ে যান । লক্ষ্মীবাঈ সোজা চলে যান গোয়ালিয়রে । সেখানে তিনি সিন্ধিয়াদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানান । কিন্তু সিন্ধিয়ারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ নিয়ে রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে । শেষ পর্যন্ত ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মৃত্যু বরণ করেন ।
ঝাঁসির শেষ যুদ্ধে রানী লক্ষ্মীবাই তাঁর ছেলে দামোদর রাওকে তার পিঠে বেঁধে যুদ্ধ করার কথা সবার মনে আছে। রাণীর চিতা পুড়িয়ে ফেলার পর সেই ছেলের কী হয়েছিল, তা সকলের অজানা । ব্রিটিশরা দামোদর রাওকে কখনই ঝাঁসির উত্তরাধিকারী বলে মনে করেনি, তাই সরকারী নথিতে তার স্থান ছিল না। বেশিরভাগ ভারতীয় সুভদ্রা কুমারী চৌহানের রূপক বর্ণনাকে ইতিহাস বলে মনে করে এবং কাহিনীকে ওখানেই শেষ করে দেয় ।
দামোদর রাওয়ের একমাত্র বর্ণনা ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ওয়াই এন কেলকরের মারাঠি বই ‘ইতিহাসাচ্য সহলি’ (এ জার্নি ইন হিস্ট্রি) গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। রাণীর মৃত্যুর পর দামোদর রাও অভিশপ্ত জীবন যাপন করেন। তার দুর্দশার জন্য শুধু বিদেশীরাই নয়, ভারতের মানুষও সমানভাবে দায়ী ছিল ।
দামোদরের কথায়,’আমার জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৮৪৯ সালে নাভালকার রাজপরিবার বংশে হয়েছিল । জ্যোতিষী বললেছিলেন আমার রাশিতে নাকি রাজযোগ আছে এবং আমি রাজা হব । এটি আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক উপায়ে সত্য হয়েছিল। মহারাজ তিন বছর বয়সে আমাকে দত্তক নেন। দত্তক নেওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন আসার আগেই বাবা মারা যান। মা সাহেব (মহারাণী লক্ষ্মীবাঈ) কলকাতায় লর্ড ডালহৌসির কাছে বার্তা পাঠালেন যে আমাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণ করা হোক। কিন্তু ব্রিটিশরা মেনে নেয়নি ।
ডালহৌসি ঝাঁসিকে ব্রিটিশ রাজের সাথে যুক্ত করার নির্দেশ দেন। মা সাহেবকে বার্ষিক ৫,০০০ টাকা পেনশন দেওয়া হবে বলে জানানো হয় । এর সাথে মহারাজের সমস্ত সম্পত্তিও মা সাহেবের কাছে থাকবে। মা সাহেবের পর তাঁর ভান্ডারে আমার পূর্ণ অধিকার থাকবে কিন্তু ঝাঁসির রাজা হতে পারব না । এছাড়া বাবার সাত লাখ টাকাও ব্রিটিশ রাজকোষে জমা ছিল। বিদেশিরা বলেছে, প্রাপ্তবয়স্ক হলে আমাকে টাকা দেওয়া হবে।
মা সাহেব গোয়ালিয়রের যুদ্ধে শহীদ হন । আমার ভৃত্যরা (রামচন্দ্র রাও দেশমুখ এবং কাশী বাই) এবং অন্যরা পরে আমাকে বলেছিলেন যে মা আমাকে পুরো যুদ্ধের সময় তার পিঠে বেঁধে রেখেছিলেন। তবে আমার ভাল মনে পড়ে না সেই কথা । এই যুদ্ধের পর, আমাদের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে মাত্র ৬০ জন জীবিত ছিলেন । নহে খান রিসালেদার, গণপত রাও, রঘুনাথ সিং এবং রামচন্দ্র রাও দেশমুখ ২২ টি ঘোড়া এবং ৬০ টি উট নিয়ে তিনি বুন্দেলখণ্ডের চান্দেরির দিকে রওনা হন। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, রান্না-বান্না আর থাকার জায়গা কিছুই ছিল না। আমরা কোনো গ্রামে আশ্রয় পাইনি। মে ও জুন মাসের গরমে আমরা খোলা আকাশের নিচে গাছের তলায় রাত কাটিয়েছি। সৌভাগ্যবশত, বনজ ফলের কারণে কখনো ক্ষুধার্ত হয়নি। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হলো বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে। প্রবল বর্ষায় ঘন জঙ্গলে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই সময় এক গ্রামের প্রধান আমাদের খাবার দিতে রাজি হল। রঘুনাথ রাও-এর পরামর্শে আমরা ১০ জনের দলে ভাগ হয়ে থাকতে শুরু করি।
প্রধান এক মাসের রেশনের মূল্য নির্ধারণ করেন এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে ৫০০ টাকায় ৯ টি ঘোড়া এবং চারটি উট ভাড়া দেয় । আমরা যেখানে ছিলাম সেটি একটি জলপ্রপাতের কাছাকাছি এলাকা ছিল এবং দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যায় সেখানে । আমরা যখন গোয়ালিয়র ছেড়েছিলাম, তখন আমাদের কাছে ৬০,০০০ টাকা ছিল, যা এখন সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেছে। আমার স্বাস্থ্য এতটাই খারাপ হয়ে গেল যে সবাই ভেবেছিল আমি আর বাঁচব না। আমার লোকেরা প্রধানের কাছে একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছিল।
আমার চিকিৎসা হয়েছে ঠিকই কিন্তু টাকা ছাড়া আমাদের সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। আমার লোকেরা প্রধানকে ২০০ টাকা দিয়েছে এবং পশুগুলি ফেরত নিয়ে নিয়েছিল । তিনি আমাদের মাত্র ৩ টি ঘোড়া ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর, গোয়ালিয়রের শিপ্রির গ্রামবাসীরা আমাদেরকে বিদ্রোহী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারা আমাদের সেখানে তিন দিন আটকে রাখে, তারপর সৈনিকদের সঙ্গে ঝালারপাটনের পলিটিক্যাল এজেন্টের কাছে পাঠায়। আমার লোকেরা আমাকে ছাড়েনি । একের পর এক তারা আমাকে তাদের পিঠে বসিয়ে নিয়ে যায় সেখানে । মা সাহেবের রিসালেদার নানহে খানের পলিটিক্যাল এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি মিঃ ফ্লিঙ্ককে বলেন যে ঝাঁসির রানি সাহিবার সন্তানের বয়স এখনও ৯-১০ বছর। রানী সাহেবার পর তাকে বনে জঙ্গলে পশুর মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে । শিশু থেকে সরকারের কোনো ক্ষতি নেই। ওকে ছেড়ে দাও, সারা দেশ তোমাকে আশীর্বাদ করবে। ফ্লিঙ্ক একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন, তিনি আমাদের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আমার পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেখান থেকে আমরা আমাদের আস্থাভাজনদের সাথে ইন্দোরের কর্নেল স্যার রিচার্ড শেক্সপিয়ারের সাথে দেখা করতে রওনা হলাম। তখন আমাদের আর কোনো টাকা অবশিষ্ট ছিল না।
যাতায়াত খরচ ও খাবারের জন্য মা সাহেবের ৩২ তোলার মধ্যে দুই তোলা দিয়ে দিতে হল । এটাই ছিল মা সাহেবের আমার শেষ স্মৃতি । এর পরে ১৯৬০ সালের ৫ মে, ব্রিটিশরা ইন্দোরে দামোদর রাওকে বার্ষিক ১০,০০০ টাকা পেনশন দেয়। তার সঙ্গে মাত্র সাতজনকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল। ব্রিটিশ সরকারও সাত লাখ টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে।দামোদর রাওয়ের প্রকৃত পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে লালন-পালন করেন। ১৮৭৯ সালে তাদের লক্ষ্মণ রাও নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়। দামোদর রাওয়ের দিন কাটে চরম দারিদ্র্য ও অজ্ঞাতবাসে । এর পরেও ব্রিটিশরা তাদের উপর কড়া নজরদারি রেখেছিল। দামোদর রাওয়ের পাশাপাশি তাঁর ছেলে লক্ষ্মণরাওকে ইন্দোরের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি।
তাঁর পরিবারের সদস্যরা এখনও ‘ঝাঁসিওয়ালে’ উপাধি নিয়ে ইন্দোরে থাকেন। রাণীর এক সৎ ভাই চিন্তামনরাও তাম্বে ছিল। তাম্বে পরিবার বর্তমানে পুনেতে থাকে। ঝাঁসির রানীর বংশধরেরা ইন্দোর ছাড়াও দেশের আরও কিছু জায়গায় বাস করে। তারা তাদের নামের সাথে ঝাঁসিওয়ালে লেখেন ।১৮৬০ সালের ৫ মে দামোদর রাও নেওয়ালকার যখন ইন্দোরে পৌঁছান, তখন তাঁর মাসি, যিনি দামোদর রাও-এর প্রকৃত মা ছিলেন, ইন্দোরে থেকে যান। যখন সে বড় হয়, তিনি দামোদর রাওয়ের বিয়ে দেন কিন্তু কিছু সময়ের পর দামোদর রাওয়ের প্রথম স্ত্রী মারা যায়। দামোদর রাওয়ের দ্বিতীয় বিয়ে থেকে লক্ষ্মণ রাও জন্মগ্রহণ করেন। দামোদর রাওয়ের দুঃখজনক এবং কঠিন জীবন ১৯০৬ সালের ২৮ মে ইন্দোরে শেষ হয়েছিল।পরবর্তী প্রজন্মে, লক্ষ্মণ রাও-এর ছেলেরা হলেন কৃষ্ণ রাও এবং চন্দ্রকান্ত রাও। কৃষ্ণ রাওয়ের দুই ছেলে ছিল, মনোহর রাও, অরুণ রাও এবং চন্দ্রকান্তের তিন ছেলে, অক্ষয় চন্দ্রকান্ত রাও, অতুল চন্দ্রকান্ত রাও এবং শান্তি প্রমোদ চন্দ্রকান্ত রাও।দামোদর রাও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন তিনি তার মায়ের স্মরণে অনেক চিত্রকর্ম করেছেন, যা ঝাঁসি পরিবারের অমূল্য ঐতিহ্য।
তাঁর বংশধর শ্রী লক্ষ্মণ রাও এবং কৃষ্ণা রাও ইন্দোর কোর্টে টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। অরুণ রাও ২০০২ সালে মধ্যপ্রদেশ বিদ্যুৎ বোর্ড থেকে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার ছেলে যোগেশ রাও একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বংশধরদের মধ্যে, প্রপৌত্র অরুণরাও ঝাঁসিওয়ালা, তাঁর স্ত্রী বৈশালী, ছেলে যোগেশ এবং পুত্রবধূ প্রীতি ইন্দোরের ধন্বন্তরি নগরে সাধারণ নাগরিকদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে জীবন যাপন করছেন ।।বহু সাহসী সম্রাটের এই অখন্ড ভারতে কোনো বিদেশী হানাদার আমাদেরকে দাস করতে পারত না, যদি আমাদের নিজেদের লোকেরা কাপুরুষতা না দেখাত,’এক দেশ এক জাতি’র চিন্তা থাকত ভারতবাসীর মধ্যে ।।