জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,গুসকরা(পূর্ব বর্ধমান),২৯ মে : এতদিন ওরা ছিল খোলা মঞ্চের নিছক দর্শক বা শ্রোতা। আশেপাশে কোথাও কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে ভিড় বাড়াতে যেত। মাঝে মাঝে গানের তালে হয়তো কোমর দুলিয়ে দিত। অবচেতন মনে স্বপ্নের জাল বুনলেও নিজেদর সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে মনের মধ্যেই সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটত। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে মনের গোপন কোণে চেপে রাখা ইচ্ছে বাস্তবায়িত হলো। মঞ্চে উঠল, প্রথম বারের জন্য নৃত্য প্রদর্শন করে দর্শকদের প্রশংসা আদায় করল। তারপর বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাসে মেতে উঠল ‘ওরা’, গুসকরা স্টেশন সংলগ্ন এলাকার একদল অসহায় শিশু। সৌজন্যে গুসকরা ‘নতুন দিশা’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সুবীর রানা ও তার সহযোগীরা ।
সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে ২৯ শে মে গুসকরা বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল হলে বহু বিশিষ্ট মানুষের উপস্থিতিতে ‘রবীন্দ্র-নজরুল’ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী করবী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও সঙ্গীত পরিবেশন করেন শুভ্রা লাহা। ক্ষুদে শিল্পী সম্পূর্ণা গোস্বামীর আবৃত্তি উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। একে একে পরিচিত শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লেখা গান, নৃত্য ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের শিল্প নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। তারপরই চমক। একদল অপরিচিত শিশু শিল্পী মঞ্চে হাজির এবং তারা তাদের শিল্প নৈপুণ্যের মাধ্যমে হল ভর্তি দর্শকদের মাতিয়ে দিল। চমক ভাঙতেই গুসকরাবাসীরা দেখলেন ওরা স্টেশন চত্বরে ঘুরে বেড়ানো সেই অসহায় শিশুরা। এদের অভিভাবকরা ভিক্ষা করে দিন গুজরান করে। আর ওরা রবিবারের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সেদিন ওদের মুখে ‘নতুন দিশা’ একমুঠো অন্য তুলে দেবে। কার্যত ওরা এই একদিনই পেটপুরে খেতে পায়। আর এই রবিবারেই তারা এক অন্য স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরল ।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল দেবেশ রায়ের কবিতা অবলম্বনে নাটক
‘২৫ শে বোশেখ’। নাট্যরূপ, নির্দেশনা ও মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন সুবীর রানা। তার অসাধারণ অভিনয়ে মুগ্ধ দর্শকরা বারবার হাততালি দিতে বাধ্য হয়। এছাড়া প্রতিটি শিল্পীর অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নেয়।
আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক ফকির চন্দ্র পাল, বিষ্ণুপদ সিনহা, অপূর্ব মুখার্জ্জী, শিক্ষিকা কল্পনা হাজরা, বর্তমান শিক্ষক সবিতাব্রত লাহা, সংস্হার স্হায়ী সভাপতি মণিমালা মৈত্র দাস, জেলা পরিষদের সদস্য সফিউল আলম, ডাঃ শ্যামল দাস সহ বহু সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন ফকির চন্দ্র পাল এবং নজরুলের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন ডাঃ শ্যামল দাস। তারপর একে একে বিশিষ্ট অতিথিরা দুই কবির প্রতিকৃতিতে পুষ্প প্রদান করেন। শহরের বাইরে থাকায় অনুষ্ঠানের শুরু থেকে থাকতে না পারলেও কিছুক্ষণের জন্য অনুষ্ঠানে হাজির হন গুসকরা পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী।
প্রসঙ্গত বছর আটেক আগে ‘নতুন দিশা’-র কর্ণধার সুবীর রানা একক প্রচেষ্টায় প্রতি রবিবার স্টেশন চত্বরের অসহায় শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বহু শুভানুধ্যায়ী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। ফলে খাবার দেওয়ার দিনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এবার সেইসব অসহায় শিশুদের তৈরি করে তিনি মঞ্চে তুললেন ।
সুবীর বাবু বললেন,’আমাদের লক্ষ্য সবার সহযোগিতায় এইসব অসহায় শিশুদের সামনে নিয়ে আসা। এদের জন্য আপাতত সপ্তাহে দু’দিন করে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছি। আশাকরি ভবিষ্যতে সবার সহযোগিতায় আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব ।’।