প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২১ ডিসেম্বর : কিছু পুতুল নিয়ে গান বাজনার মধ্য দিয়ে লোক সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। যা পুতুল নাচের আসর নামেই প্রসিদ্ধ।একদা এই বাংলার আবালবৃদ্ধ বনিতা থেকে শুরুকরে শিশুরদের কাছেও বিনোদনেরও মাধ্যম ছিল পুতুল নাচ।কিন্তু বর্তমান ডিজিটালইজেশনের যুগে পুতুল নাচ ও বাধাই গান যেন বড়ই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গিয়েছেন।তবে আজও এই বাংলায় এমনও কিছু সংস্কৃতিবান মানুষ আছেন যাঁরা ইন্টারনেট কানেকশন যুক্ত অ্যান্ড্রয়েড ফোন হাতে নিয়ে ঘুরলেও পুতুল নাচ ও বাধাই গানকে ভুলতে চান না।তেমনই কিছু মানুষজনের উদ্যোগেই আজও পূর্ব বর্ধমান জেলার পুটশুড়ীর মেলায় সমাদর পেয়ে আসছে বাধাই গান ও পুতুল নাচের আসর।শুধুমাত্র এইসব প্রাচীন লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার টানে পুতুল নাচ ও বাধাই গানের আসরে ভিড় জমান বহু সংস্কৃতিবান মানুষ।তাদের সকলেরই বক্তব্য,’বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাচীন এই লোকশিল্পকে কোন ভাবেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না’ ।
রাজ্যের শস্যগোলা হিসাবেই পরিচিত পূর্ব বর্ধমান জেলা।জমির পাকা ধান গোলায় তোলার কাজ
অগ্রহায়নেই সেরে ফেলেছেন এই জেলার চাষিরা। তারপর নবান্ন উৎসব কাটিয়ে এখন জেলার চাষি পরিবার গুলি মাতোয়ারা পৌষ পার্বনে ।আর এই উৎসব মরশুকে সামনে রেখেই প্রতিবছর পয়লা পৌষ থেকে জেলার মন্তেশ্বরের পুটশুড়ী গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মেলা। মেলা সাত দিন ধরে চলে। যে মেলার মূল উদ্দেশ্য হল হারিয়ে যেতে বসা বাংলার লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা । সেই মতই পুতুল নাচ ও বাধাই গানের শিল্পীরাই এই মেলায় আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন ।
মেলা কমিটির সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জানান,
২৩ বছর ধরে পুটশুড়ী গ্রামে এই মেলা হয়ে আসছে। কৃষি ,স্বাস্থ্য ,শিক্ষা ও সচেতনতার বিষয় গুলিকে এই মেলায় তুলে হয় । তার সঙ্গে প্রাধান্য দেওয়া হয় হারিয়ে যেতে বসা বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা । তাই প্রতিবছর এই মেলায় পুতুল নাচ ও বাধাই গানের শিল্পীদের আমন্ত্রন জানানো হয় ।তারা তাঁদের শিল্পকলা পরিবেশন করেন।সত্যেন্দ্রনাথ বাবুর কথা অনুযায়ী,’মেলার কটা দিন পুটশুড়ী কার্যত হয়ে ওঠে বাংলায় প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কেন্দ্রস্থল’।
এই মেলায় অংশ নেন নদীয়ার পুতুল নাচের এইটি দলের ১০ জনের শিল্পী দল। বুধবার সন্ধ্যায় তারা মেলার মঞ্চে পরিবেশন করেন সামাজিক পালা ’মুশকিল আসান’। পুতুল নাচের এই পালায় লোক শিক্ষার কোন বিষয়টিকে তুলেধরা হয়েছে ? উত্তরে
পুতুল নাচ দলের এক শিল্পী নিখিল সরকার বলেন
, সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে সঠিক ও ন্যায়ের পথ
কি ,সেটাই পুতুল নাচের এই পালাগানের মধ্যদিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। পুতুল নাচের পালাগান কি এখন
আগের মহিমায় ফিরছে? উত্তরে নিখিলবাবু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, পুতুল নাচ এখন একপ্রকার বিলুপ্তির পথে। তবুও আমরা কয়েক জন প্রাচীন এই শিল্পকলাকে বাচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।। তবে এর থেকে রোজগার তেমন কিছুই হয় না। শুধুমাত্র আগামী প্রজন্মের কাছে পুতুল নাচের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমরা এখনও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে পুতুল নাচের পালাগান করে যাচ্ছি।এ ছাড়াও গ্রামে গঞ্জে এখনও কিছু শিল্পানুরাগী মানুষ আছেন , যাঁরা বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান ।তাই পুতুল নাচ এখনও অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে বলে নিখিল সরকার দাবি করেন? সরকারী কোন সাহায্য সহযোগীতা কি পান? এর উত্তরে নিখিল বাবু জানান,’আগে কিছুই মিলতো না । এখন পুতুল নাচের শিল্পী হিসাবে মাসে ১ হাজার টাকা সান্মানিক মিলছে’ । একই ভাবে বাধাই গানের শিল্পীরাও তাদের শিল্পের দুরাবস্থা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাল করছেন।
পূর্ব বর্ধমান জেলাপরিষদের সভাধীপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন,আমাদের সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। আগে তো কোন সরকারই বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের পাশে দাঁড়ায় নি। আমাদের সরকার এইসব শিল্পীদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন কি সামান্য হলেও তাদের জন্য সরকার থেকে শিল্পী ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। পুতুল নাচ , বাধাই গান ,এসবের প্রতি গ্রামের মানুষজনের এখনও একটা আলাদা টান রয়েছে। তাই এই শিল্প কখনও বিলুপ্ত হওয়ার নয় বলে সভাধীপতি মন্তব্য করেছেন ।।