এইদিন স্পোর্টস নিউজ,২০ আগস্ট : অসাধারণ ব্যাটিং পারফরম্যান্সের জন্য তাকে বলা হত ‘নতুন টেন্ডুলকার’ । তারপর ধারাবাহিক ব্যর্থতায় ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকেন ৷ অবশেষে খাদের কিনারা থেকে ফের মেলে ধরলেন তিনি । নতুন দলে নাম লিখিয়ে এখন তিনি চেষ্টা করছেন আঁধার কাটিয়ে আলোয় ফেরার । তার নিজের ভাষায় ‘শূন্য থেকে শুরু।’ সেই পথচলার শুরুতেই টার্নি উইকেটে দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে জানিয়ে দিলেন,তার লড়াকু মানসিকতার কথা।মুম্বাই দলে জায়গা হারানোর পর গত মাসেই মহারাষ্ট্র দলে নাম লেখান পৃথ্বী শ। নতুন দলের হয়ে প্রথম ম্যাচেই তিনি উপহার দিলেন শতরান। বুচি বাবু আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্টে ছত্রিশগড়ের বিপক্ষে ১৪১ বলে করেন তিনি ১১১ রান।
চেন্নাইয়ের টার্নিং ও অসম বাউন্সের উইকেটে ভুগেছেন অন্য সব ব্যাটসম্যান। মহারাষ্ট্রের অন্য ১০ ব্যাটসম্যান মিলে করতে পারেন মেটে ৯২ রান!দারুণ ব্যাটিংয়ের পর দিন শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এই ওপেনার বললেন, ঘুরে দাঁড়ানোর বিশ্বাস তার প্রবলভাবেই আছে।“শূন্য থেকে আবার শুরু করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কারণ জীবনে অনেক উত্থান-পতন থেকেছি আমি। চূড়ায় উঠেছি, পতনো হয়েছে, ফিরেও এসেছি আগে। আমার মনে হয়, এখনও সবকিছু সম্ভব। আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী মানুষ, নিজের ওপর ও নিজের কাজের ধরনে আস্থা রাখি। আশা করি এবং এটা অনুভবও করছি, নতুন মৌসুম আমার জন্য, আমার দলের জন্য ভালো যাবে।”
শুনলে মনে পারে অনেক বয়সী ও জীবনে প্রচুর পোড় খাওয়া কেউ একজন বুঝি। আদতে তার বয়স এখনও মোটে ২৫। তবে জীবনের অনেক গলি তার ঘোরা হয়ে গেছে । ক্রিকেট অনুসরণ করে থাকলে তার গল্পটাও সবার জানা। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই লোকের মুখে মুখে ছিল তার নাম। ‘নতুন টেন্ডুলকার’ হিসেবেও ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তার শারীরিক গড়নে মিল তো ছিলই, আরও বেশি মিল ছিল প্রতিভার, খেলার ধরন আর পারফরম্যান্সে। টেন্ডুলকারের মতোই স্কুল ক্রিকেটে সাড়া জাগিয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ঝড় তুলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে চমকপ্রদ পারফর্ম করে দ্রুতই টেস্ট দলে আসেন তিনি।
প্রথম আলোচনার খোরাক জোগান তিনি ১৪ বছর বয়সে স্কুল ক্রিকেটে ৩৩০ বলে ৫৪৬ রানের ইনিংস খেলে। সেই সময়ে রেকর্ড ছিল সেটি। পরে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও আলো ছড়াতে থাকেন ভারতের হয়ে। যুব এশিয়া কাপ জয়ের স্বাদ পান।
রঞ্জি ট্রফি অভিষেকে তামিলনাড়ুর বিপক্ষে সেমি- ফাইনালে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়ায় দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করে মুম্বাইকে যখন ফাইনালে তোলেন, তার বয়স তখন সবে ১৭ পেরিয়েছে। ওই বছরের নভেম্বরে দিলীপ ট্রফি অভিষেকে সেঞ্চুরি করেন সবচেয়ে কম বয়সে, যে রেকর্ডটি আগে ছিল টেন্ডুলকারের।পরে ভারতকে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন তিনি। আসরে নিজেও ছিলেন সফল, ৬৫.২৫ গড়ে করেন ২৬১ রান। ওই টুর্নামেন্ট চলার সময়ই আইপিএলের নিলামে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় তাকে দলে নেয় দিল্লি ডেয়ার ডেভিলস। আইপিএলে অভিষেক আসরে ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ে নজর কাড়েন সবার, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আদায় করে নেন কোচ রিকি পন্টিংয়ের।
এরপর ভারতের ‘এ’ দলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পথ ধরে জায়গা করে নেন টেস্ট দলে। টেস্ট অভিষেকে ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রাজকোটে উপহার দেন ১৫৪ বলে ১৩৪ রানের ইনিংস। অভিষেকে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ডও গড়েন। এমন স্বপ্নময় যার পথচলা, তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে আছে এখন ৫ টেস্ট, ৬ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টিতে। ভারতের জার্সিতে সবশেষ ম্যাচটি খেলেছেন বছর চারেক আগে।
গত কয়েক বছরে অনেকবারই খবরের শিরোণামে উঠে এসেছেন তিনি। নাম-যশ-খ্যাতি-অর্থ তার মাথায় উঠে গিয়েছিল, সামলাতে পারেননি বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। ফিটনেস হারিয়েছেন, শৃঙ্খলা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। সব ধরনের ক্রিকেটে সব জায়গায় পারফরম্যান্স গেছে হারিয়ে। ফেরার লড়াই শুরু করেছেন বলেও খবর এসেছে কয়েক দফায়। কিন্তু তিনি পেছন পানেই ছুটেছেই। সবশেষ গত অক্টোবরে মুম্বাই রাজ্য তল থেকেও তিনি বাদ পড়েন ফিটনেসের ঘাটতি আর আচরণগত সমস্যার অভিযোগে। স্বীকৃত ক্রিকেটে তাকে সবশেষ দেখা গেছে গত ডিসেম্বরে সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে। মুম্বাইয়ের হয়ে সেই আসরেও তার ব্যাট কথা বলেনি।
মুম্বাই থেকে বাদ পড়ে আরেকদফা অস্তিত্বের লড়াইয়ে পড়েন তিনি। নতুন সহায় হয়ে আসে মহারাষ্ট্র দলে সুযোগ। খড়কুটো আঁকড়েই এখন তার ভেসে চলার চেষ্টা। এই সেঞ্চুরি সেই চেষ্টায় হতে পারে তার বড় সহায়। বুচি বাবু টুর্নামেন্টের প্রথম শ্রেণির স্বীকৃতি না থাকলেও প্রাক-মৌসুম টুর্নামেন্ট হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয়। ভারতের শীর্ষ ক্রিকেটারদের অনেকেই এই আসরে খেলে নিজেদের ঝালিয়ে নেন নতুন মৌসুমের জন্য। ছত্রিশগড়ের বিপক্ষে পৃথ্বীর ইনিংসটিতে ছিল তার সেই চেনা আগ্রাসী ধরনই। তার উদ্বোধনী জুটির সঙ্গী সাচিন দাস যখন ২৫ বল খেলে প্রথম রান করেন, পৃথ্বী ততক্ষণে ২৩ বলে ৩০ করে ফেলেছেন। ফিফটি করে ফেলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ৭১ রানের উদ্বোধনী জুটির পর দ্রুত একের পর এক উইকেট হারায় মহারাষ্ট্র। তবে বিরুদ্ধ স্রোতেই এগিয়ে সেঞ্চুরি পেরিয়ে যান পৃথ্বী। ১৫ চার ও ১ ছক্কায় ইনিংস খেলে যখন তিনি আউট হন, দলের ১৬৬ রানের মধ্যে তার একারই রান ১১১ ।
পৃথ্বীর দাবি, ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলছেন তিনি। “গত দুই-তিন মাস ট্রেনার ছিল আমার সঙ্গে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। একজন ডায়েটিশিয়ানও আছেন, যিনি আমাকে খাবার ও অন্যান্য পরিকল্পনা দিচ্ছেন, তারা যেমন দিয়ে থাকেন। এই কয় মাস তাই আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বদলে দিয়েছে। মাঠের বাইরেও তা দেখতে পাবেন।আগে আমি অনেক দূরের কথা ভাবতাম। আমার জন্য তা কাজে দেয়নি এখন আমি প্রতিটি দিন হিসেবে ভাবছি, আমার সামনে সূচি কেমন আছে, ম্যাচ খেলছি নাকি খেলছি না… সেভাবেই এগোচ্ছি। এক মাস পরে, এমনকি দুই দিন পরেরটা নিয়েও ভাবছি না। বর্তমানে থাকার চেষ্টা করছি। আমি এখন তেমনই একজন মানুষ।”।