এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১১ ফেব্রুয়ারী : গত বৃহস্পতিবার বিধানসভায় ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছেন রাজ্যের অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য । চলতি অর্থবর্ষের জন্য ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে । সরকারি দফতরে ৫ লাখ চাকরির ঘোষণা করা হয়েছে । এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশ , গ্রিন পুলিশের জন্য আরও একহাজার সাম্মানিক বৃদ্ধি, আলুচাষিদের সহায়তা, শস্য বিমার প্রিমিয়াম বাবদ অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে । এছাড়া লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে ভাতা ৫০০ থেকে বেড়ে ১০০০ টাকা, জনজাতি মহিলাদের জন্য ভাতা হাজার থেকে বেড়ে ১২০০ টাকা করা হয়েছে । এদিকে রাজ্য সরকারের এই বাজেটকে ‘দিশাহীন বাজেট’ বলে খোঁচা দিলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ।
শুভেন্দু অধিকারী নিজের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে লিখেছেন,’পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এক দিশাহীন বাজেট পেশ করেছেন অর্থ মন্ত্রী। না আছে রাজ্যকে আত্মনির্ভরতার পথে সঞ্চালন করার দিকচিহ্ন, না রয়েছে কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টা। মূলধন ব্যয় বৃদ্ধিতে অনীহা আদপে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা উন্নত করার বিষয়ে সরকারের অভিসন্ধির প্রতি প্রশ্নচিহ্ন তুলতে বাধ্য করে।
বিধানসভায় বাজেট বিতর্কে অংশগ্রহণের সময় আমি কিছু তথ্য তুলে ধরেছি, যা থেকে প্রমাণ হয় যে ১০০ দিনের কাজ নিয়ে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। যে বিপুল পরিমাণ চুরি ও MGNREGA প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের নয়ছয় হয়েছে রাজ্যে তা ঢাকতে আজ সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। উপঢৌকনের মাধ্যমে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকার আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি লিখেছেন,’রাজ্য বাজেট সংক্রান্ত আমার বক্তব্যের কিছু অংশ জনসমক্ষে তুলে ধরছি:-
বিগত ইউপিএ সরকারের তুলনায় বর্তমান এনডিএ সরকারের আমলে রাজ্যের বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় তিন গুন। পশ্চিমবঙ্গে MGNREGA (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন) প্রকল্পে ইউপিএ সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গ কে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল ১৪,৯৮৫ কোটি টাকা। এনডিএ সরকারের আমলে সেই বরাদ্দকৃত অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় ৫৪,১৫০ কোটি টাকায়।
এত বিপুল অর্থ দেখে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের লোভ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যায়, প্রশাসনের একাংশের মদতে শুরু হয় লুঠ। ভুয়ো জব কার্ড, কাজ না করে পেমেন্ট দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে রাজ্যের সমস্ত এলাকায় । লুঠ আটকাতে যখন কেন্দ্রীয় সরকার জব কার্ডের সাথে আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা বাধ্যতামূলক করেন, তখন ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ে! রাজ্যের প্রায় ১,৩০,০০,০০০ জব কার্ড ম্যাজিকের মতো উবে গিয়েছে। অর্থাৎ এই জব কার্ড গুলি যাদের নামে ছিল তারা ভুয়ো। শুধুমাত্র দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আর মুর্শিদাবাদেই যথাক্রমে ১৫ লক্ষ এবং ১৩ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ড বাতিল হয়েছে। গত দশ বছর ধরে এই ভুয়ো জব কার্ড দেখিয়ে MGNREGA তহবিলের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে রাজ্যে। এবং এই লুটের টাকার অঙ্কটা এতটাই যা অনুমান করাও দুষ্কর। রজ্যে MGNREGA তহবিলের বেশিরভাগই ভুয়ো জব কার্ড গ্রাহকদের মজুরি প্রদানে ব্যয় করা হয়েছে এবং এসব কিছুই হয়েছে শাসক দলের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ মদতে ।
অন্য একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন,’রাজ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী ২ কোটি বেকারের কর্ম সংস্থানের দাবী করেছেন যা সর্বৈব মিথ্যা বরং এই সরকার ২০১২ সালের পর থেকে বছরে ৬ লক্ষ সরকারি স্থায়ী পদের অবলুপ্তি ঘটিয়েছে। স্থায়ী নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে সামান্য বেতনে অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কিছু কর্মী নিয়োগ করেছে সরকার তাও পর্যাপ্ত নয়। রাজ্যে বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলস্বরুপ রাজ্যের ৫০ লক্ষ বেকার তাদের সংসার প্রতিপালনের জন্য পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে রাজ্যের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে কাজ করছেন।
২০২১এর বিধানসভার আগে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের বেকারদের ডবল ডবল চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যা আসলেই তার তল্পিবাহক সরকারি আমলাদের জন্য যাদের অবসর নেওয়ার পরও তিনি মোটা মাইনে দিয়ে সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে বসিয়ে রেখেছেন। এদিকে মেধাযুক্ত শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীরা বছরের পর বছর রাস্তায় বসে রয়েছেন। সরকারের এই বাজেটে রাজ্যের বেকারদের জন্য কর্ম সংস্থানের কোনো দিশা নেই যেটা আছে তা হল গল্পের গরুকে গাছে তুলে দেখানোর সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রচেষ্টা।
বাজেট বিতর্কে রাজ্য বাজেট সংক্রান্ত আমার বক্তব্যে বিরোধী দলনেতা হিসেবে আমি বেশ কিছু দাবী সরকারের কাছে রেখেছি। ১২ দফার দাবীটি আমি সর্বসমক্ষে সকলের জ্ঞাতার্থে এখানে দিলাম ।
১. মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তার জবাবী ভাষনে রাজ্যসরকারের অধীনস্থ সকল কর্মচারী সহ শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারী এবং সমস্ত পেনশন প্রাপকদের জন্য কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্যভাতা এবং ২০১৫ সাল থেকে Arear এর কথা ঘোষনা করুন এই দাবী রাখছি।
২. অসম সরকারের মতো মাতৃশক্তিকে ১০০০ টাকার পরিবর্তে ২৫০০ টাকা দেওয়ার ঘোষণা করুন এই দাবী রাখছি।
৩. রাজস্থান সরকারের মতো ৪৫০ টাকায় LPG গ্যাস সিলিন্ডার (Domestic) দেওয়ার ঘোষণা করুক পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই দাবী রাখছি।
৪. উত্তরপ্রদেশ সরকারের মতো বছরে একটি করে গ্যাস সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেওয়ার দাবী রাখছি।
৫. পেট্রোল এবং ডিজেলে রাজ্য সরকার যে সেস নিচ্ছে, এটা রাজ্য সরকার মকুব করুক অথবা উত্তরপ্রদেশ, অসম ইত্যাদি অন্যান্য রাজ্যের সরকারের মতো অর্ধেক সেস ছাড় ঘোষণা করুক এই দাবী রাখছি
৬. ২০১২ সালের পর থেকে রাজ্য সরকারের স্থায়ী নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি ৬ লক্ষ স্থায়ীপদের অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। ২০১৯ সালে নিয়োগের শেষ বিজ্ঞপ্তি এবং SSC এর শেষ বিজ্ঞপ্তি ২০১৭ সালে। অবিলম্বে SC, ST, OBC এবং EWS সংরক্ষণ দিয়ে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সমস্ত শূন্যপদ পূরণের দাবী রাখছি।
৭. প্রাইমারী টেট পরীক্ষার জন্য ধার্য্য পরীক্ষার খরচ ১৫০টাকার বদলে ৫০০টাকা করা হয়েছে। বেকার যুবক যুবতীদের স্বার্থে বিহারের মতো সমস্ত কর্মপ্রার্থীদের পরীক্ষার খরচ সম্পূর্ণ মকুব করার দাবি জানাচ্ছি।
৮. সমকাজে সমবেতন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কার্যকর হওয়া উচিত। সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রীন পুলিশ, ভিলেজ পুলিশ এর বেতন নূন্যতম ২০০০০/- হওয়া উচিত। ওড়িশা এবং বিহারের মতো পার্শ্বশিক্ষক, আংশিক, সহ শিক্ষক সহ সমস্ত অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মী দের স্থায়ীকরনের দাবী জানাচ্ছি।
৯. আশাকর্মী, আইসিডিএস, প্রানীমিত্র, VRP, Tax Collector, চুক্তিভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ার, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, Third Party Pay Roll এবং WEBEL এর মাধ্যমে নিযুক্ত সকলের বেতন ৫০০০ টাকা বৃদ্ধির দাবী রাখছি।
১০. পশ্চিমবঙ্গে ৪২ লক্ষ কৃষক পিএম কিষান সম্মাননিধি পান। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রদেশের মতো কেন্দ্র সরকারের ৬০০০ টাকার সঙ্গে রাজ্য সরকারের আরো ৬০০০ টাকা মানে ১২০০০ টাকা কৃষকদের দেওয়ার প্রস্তাব রাখছি। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকারের কৃষকবন্ধু প্রকল্পের ৫০০০ টাকাকে দ্বিগুণ করার দাবি রাখছি।
১১. আমি আমার বাজেট বক্তৃতার শেষাংশে রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে পশ্চিমবঙ্গে আয়ুষ্মান ভারত, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা এবং প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় ৭৫ লক্ষ নতুন সংযোগ দেওয়ার যে কাজ চলছে, যার মধ্যে ৫০ লক্ষ কানেকশন সম্পন্ন হওয়ায় সারা ভারতের প্রায় ১০ কোটির বেশি মাতৃশক্তি উপকৃত হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মা, দিদি ও বোনেদের স্বার্থে অবিলম্বে এই প্রকল্প চালু করার দাবী জানাচ্ছি।
১২. বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিল ৬০ লক্ষ টাকার পরিবর্তে ২ কোটি করার দাবী জানাই।
রাজ্যের কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছে লোকসভা ভোটের আগে জনমোহিনী বাজেট পেশ করেছে রাজ্য সরকার । লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, সিভিক ভলান্টিয়ার-গ্রিন পুলিশ-ভিলেজ পুলিশদের ভাতা বাড়ানো এবং অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য একাধিক জনমোহিনী প্রকল্পের ঘোষণা করলেও কীভাবে আয় হবে, সেটার কোনও নির্দিষ্ট দিশা দেখাননি তিনি । ফলে এই বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয় কোথা থেকে হবে তা এখনও স্পষ্ট নয় ।।