প্রচলিত সাধারণ প্রাণায়ামে পূরক, রেচক ও কুম্ভক এই তিনটি কর্ম আছে। কিন্তু যোগিগণ ব্রহ্ম-সাধনের জন্য যে প্রাণায়াম করেন তাতে চেষ্টা করে কুস্তকের প্রয়োজন নেই। যোগিগণ অন্তর্মুখীভাবে কেবল রেচক ও পূরক এই দুটি কর্ম করেন এবং তাতে তাঁদের কুম্ভক আপনা হতেই হয়। শ্রীমদভগবদগীতাতে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ সেই কথাই বলেছেন –
আপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেইপানং তথাপরে। প্রাণাপানগতী রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়নাঃ।। (গীতা ৪ ।২৯)
অর্থাৎ প্রাণবায়ুকে অপানবায়ুতে এবং অপানবায়ুকে প্রাণবায়ুতে হোম কর। এইরূপ আত্মকর্ম করতে করতে প্রাণ এবং অপান বায়ুর গতি রুদ্ধ হয়ে ‘কেবল’ নামক কুম্ভক আপনা হতেই প্রাপ্ত হবে; এই অবস্থাকেই প্রাণায়ামপরায়ণ বলা হয়। যোগিরাজও তাই বলছেন এই রেচক পূরকরূণ কর্ম আরও বাড়াও, তাহলেই সিদ্ধি ও সমাধি অবস্থা আপনা হতেই লাভ করবে। তিনি আরও বলছেন এই অন্তর্মুখী রেচক পূরক ব্যতীত অন্যান্য যেসব প্রাণায়াম তা জলহীন কূপের ন্যায় বিফল। প্রাণবায়ুকে বলপূর্বক টানা ও ফেলা এই কর্ম করলেই মন আপনা হতেই নিশ্চল হযে যাবে, স্থির হয়ে যাবে। কারণ মন স্থির না হলে সাধনই হয় না, এই প্রাণকর্মই মন স্থিরের প্রধান উপায়।
এই অন্তর্মুখীন প্রাণকর্ম আরও বাড়াও অর্থাৎ রেচক পূরকরূপ কর্ম আরও অধিক কর, তাহলে রোগ থাকবে না, জন্ম জন্মান্তরের পাপরাশী জ্বলে যাবে অর্থাৎ জন্ম জন্মান্তরের পুঞ্জীভূত পাপরাশীর ধ্বংস হবে, জ্ঞান হবে এবং অজ্ঞানের নাশ আপনা হতেই হবে। রোগ এই দেহকে নষ্ট করে। যোগীর প্রথম কাজ শরীরকে সুস্থ রাখা। যোগকর্ম বীরের ধর্ম, পৃথিবীতে যত বীর আছে যোগীর মত বড় বীর কেউ নয়। কারণ সাধারণতঃ বীরের ধর্ম বাইরের শত্রুকে পরাভূত করা। যে যত অধিক ও বড় বড় শত্রুকে পরাভূত করতে পারে সে তত বড় বীর বলে গণ্য হয়। কিন্তু সেই মহান্ বীরগণও নিজের ইন্দ্রিয়রূপ শত্রুদের পরাভূত করতে পারে না। এই ইন্দ্রিয়গণই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু, যারা মানুষকে ঈশ্বরপথে চলতে দেয় না। এরা সবসময়েই প্রবৃত্তির দিকে টেনে রাখে। তাই ইন্দ্রিয়দের যাঁরা দমন করতে পারেন সেই যোগীগণকে শ্রেষ্ঠ বীর বলা যায়। কিন্তু এই ইন্দ্রিয়রূপী শত্রুদের দমন করতে হলে যে কঠোর যোগসাধনার প্রয়োজন এবং অধিক অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন তার জন্ম যোগীর সুস্থ ও নিরোগ শরীর চাই। রোগগ্রস্থ দেহে যোগসাধন সম্ভব নয়। তাই যোগিরাজ বলছেন এই অন্তর্মুখী রেচক পূরকরূণ প্রাণকর্ম অধিক পরিমাণে করলে নিরোগ শরীর লাভ করবে এবং সেই নিরোগ শরীরের দ্বারা আবো অধিক প্রাণকর্ম করতে থাকলে জন্ম জন্মান্তরের পাপরাশী জলে পুড়ে যাবে। আগুনের ধর্ম যে কোন বস্তুকে জ্বালিয়ে দেওয়া। অধিক পরিমাণে প্রাণকর্ম করলে তীব্র আত্মজ্যোতির সংস্পর্শে সমস্ত পাপরাশি জ্বলে যায়।
★ যোগীরাজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তকের অংশ ।