প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,০৩ জুন : লেখাপড়া শেখার উচাকাঙ্ক্ষা যাঁর মনে থাকে তাঁকে কোন প্রতিবন্ধকতাই হয়তো দমিয়ে রাখতে পারে না।এটা যে নিছক কথার কথা নয় সেটাই বাস্তবে প্রমাণ করে দেখালো ছাত্রী সামিনা খাতুন । মারণ ব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে জীবন সংগ্রাম চালিয়েই এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সে সাফল্যের সঙ্গে উত্তির্ণ হল। ছাত্রী সামিনার এই নজিরহীন সাফল্যাকে কুর্নিশ জানাতে শুক্রবার বিকালে তাঁর বাড়িতে হাজির হন বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে এলাকার বিধায়ক এবং পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা।সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন,মনের ইচ্ছা শক্তি থাকলে মারণ ব্যাধিও যে লেখাপড়া শেখার বাসনাকে দমিয়ে দিতে পারে না তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল সামিনা ।
পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম
রামনাথপুর ।এই গ্রামের এক প্রান্তে রয়েছে
দরিদ্র ছাত্রী সামিনাদের বাড়ি। ছোট্ট দু’কুঠুরি ঘরে পরিবারের সকলে বসবাস করেন ।তাঁর বাবা শেখ আলম পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি । তিনি খেতমজুরির কাজ করেন। মা নূরজাহান বেগম সাধারণ গৃহবধূ।সামিনার দিদি আসলিমা বিবাহিতা।
মহকুমা পুলিশ আধিকারিক (এসডিপি) সুপ্রভাত চক্রবর্তী,জামালপুর থানার ওসি রাকেশ সিং ,ব্লকের যুগ্ম বিডিও গৌতম দত্ত এদিন বিকালে সামিনার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা জানান ।পাশাপাশি চিকিৎসা ও আগামী পড়াশুনার বিষয়ে যাবতীর সাহায্য সহযোগীতার বিষয়েও তাঁকে ও তাঁর পরিবার কে আশ্বস্ত করেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা। এসডিপিও সুপ্রভাত চক্রবর্তী বলেন, ’প্রতিদিন কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই করে সামিনা মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়েছে । ওর সাফল্যের বিষয়টি আমাদের কাছেও অনুপ্রেরণার । প্রশাসনের তরফ থেকে ওকে সবরকম ভাবে সাসায্য সহযোগীতা করা হবে । সামিনা বেস্ট ট্রিটমেন্ট যাতে পায় সেই বিষয়টি দেখা হবে ।কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও হার না মেনে যে জীবনে যে সফল হওয়া যায় সেই বার্তাই সামিনা সমাজকে দিতে পেরেছে। এক কথায় সামিনাই ’রেল মডেল’ । সবাই সামিনার পাশে দাঁড়াক এটাই আমি চাইবো বলে এসডিপিও মন্তব্য করেন“। যুগ্ম বিডিও গৌতম দত্ত বলেন, “সামিনার জীবন ও সাফল্য অনুসরন যোগ্য । ওর চিকিৎসা ও আগামী দিনের পড়াশুনার ব্যাপারে যা সাহায্যের প্রয়েজন সেটা আমরা করবে ।কোন দুশ্চিন্তা মাথায় না রেখে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার কথা সামিনাকে জানান যুগ্ম বিডিও“। জামালপুরের বিধায়ক আলোক মাঝি ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মেহেমুদ খাঁন এদিন বাড়িতে গিয়ে সামিনাকে শুভেচ্ছা ছানিয়ে আসেন।
পরিবার ও এলাকাবাসীর কথায় জানা গিয়েছে ,ছোট বয়স থেকেই লেখাপড়া শেখার বিষয়ে সামিনার আগ্রহ তৈরি হয় । তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পূর্ণ করে সামিনা ভর্তি হয় স্থানীয় বনবিবিতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে।একের পর এক ক্লাসের পরীক্ষায় পাশ করে সামিনা অষ্টম শ্রেণীতে উত্তির্ণ হয়।এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সামিনার জীবনে ছন্দপতন ঘটেযায় এরপরেই ।অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত কালেই ছাত্রী সামিনার শারীরিক অসুস্থতা শুরু হয়। তাঁর বাবা মা তাঁকে জামালপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান চিকিৎসাার জন্যে । পরিবারের সকলে তখন মনে করেছিলেন জামালপুর হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের চিকিৎসাতেই সামিনা সুস্থ হয়ে উঠবে । কিন্তু তা হয় না। বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টে ধরা পড়ে সামিনার শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ ব্যাধি।তার পর থেকে টানা প্রায় তিন বছর ধরে তাঁর ক্যানসার রোগের চিকিৎসা চলছে। এখন নিয়ম করে সামিনাকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ’কেমো থেরাপি’ ও ’রেডিয়েশন থেরাপি’ নিতে যেতে হয়। এর জন্য মাথার চুল সব উঠে যাওয়ায় সামিনা প্রথমে একটু মুষড়ে পড়েছিল ঠিকই। তবে এখন তা নিয়ে সামিনা আর মাথা ঘামাতে চায়না।দশম শ্রেনীতে ওঠার পর থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হওয়ার জন্য মনোনিবেশ করে সামিনা।ক্যানসার রোগের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রনাকে দূরে সরিয়ে রেখে পড়াশুনা চালিয়ে গিয়ে সামিনা ২০৪ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ।
সমিনা জানিয়েছে,’তাঁর ’দুই কানের নিচে গলার অংশে’ ক্যানসার বাসা বেঁধেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। চিকিৎসা চলছে ঠিকই, তবে তাঁর শরীর এখন ভালো যাচ্ছে না । শরীরে জ্বর রয়ে থাকছে । গলায় ব্যাথা থাকায় ভাত গিলে খেতেও অসুবিধা হচ্ছে । তবে কষ্ট যাই থাক ,এক চান্সে মাধ্যমিক পাশ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে । পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তা তাঁর পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন।সবার শুভেচ্ছা, সহযোগীতা ও আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে উচ্চমাধ্যমীক পরীক্ষাতেও ষে সফল ভাবে উত্তীর্ণ সতে চায় ।
ছাত্রী সামিনার বাবা শেখ আলম বলেন , “আমি খেতমজুরির কাজ করে যে টুকু রোজগার করি তা দিয়েই পরিবারের সকলের দিন গুজরান হয় । দু’বছর ধরে আমার ছোট মেয়ে সামিনার ’ক্যানসার’ রোগের চিকিৎসা চলছে। মেয়ে এতবড় কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও অর্থের অভাবে তাঁকে পুষ্টিকর খাবারদাবার কিছুই দিতে পারি না।’কেমো থেরাপি’ ও ’রেডিয়েশন থেরাপির’ জন্য মেয়েকে নিয়মিত বর্ধমান হাপাতালে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা ও ওষুধের খরচ জোগাড় করতে বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য চাইতে হচ্ছে। আলম বাবু আরও বলেন, কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও তাঁর মেয়ে দমে যায়নি ।সফল ভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার জন্য সে পুরোদমে পড়াশুনা চালিয়ে যায়।এক চান্সে সামিনা মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশও করে গিয়েছে“ । সামিনার মা নূরজাহান বেগম বলেন,” সবাই সাসায্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিনে তাঁর মেয়ে একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে এই প্রত্যাশা আমার রয়েছে ।মেয়ে দ্রত সুস্থ হয়ে উঠুই এই প্রার্থনাই করে চলেছি আল্লাহর কাছে ।
বনবিবিতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
শ্যামল রায় বলেন,সামিনা খাতুন আমাদের বিদ্যালয়ের এ- বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী । প্রায় তিধ বছর ধরে তাঁর ক্যানসার রোগের
চিকিৎসা চলছে ।এতবড় কঠিন রোগের সঙ্গে
লড়াই করেও যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হওয়া যায় সেই দৃষ্টান্ত সামিনা তৈরি করেছে ।
সামিনা আমাদের চোখে ’জীবন সংগ্রামের একজন যোদ্ধা ।’।