বহমান বাতাসের প্রাবল্যে আন্দোলিত
ক্রোধী অভিমন্যুর সিংহ-সম সোনালী কেশ-রাশি।
বীরত্বের গর্জনে কম্পিত কুরুক্ষেত্রের মাটি।
উল্কা-পাতের মতো মুহুর্মুহু ছুটে আসা
প্রতিপক্ষের শরের অহংকার
আজ বশীভূত তার শর-শাসনে।
যুদ্ধের তেরোতম দিনটা যেন তারই শাসনাধীন!
সু-গঠিত বাহু, বিশাল বক্ষ,সুললিত আয়ত দুটি চোখ।
যে বক্ষে রয়েছে কৃষ্ণের শৌর্য ,বাহুতে অর্জুনের সামর্থ্য দুটি চোখে ইন্দ্রের প্রত্যয় আর
অনন্ত প্রেমের অপার রহস্য ভরা অধর।
সেই দৃপ্ত চোখ দুটি তুলে একবার
চেয়ে দেখল অভিমন্যু-
পাতক দুঃশাসন,মহাবীর কর্ণ,গুরু দোণাচার্য,
চটুল শকুনি,পাপাচারী দুর্যোধনদের
অধার্মিক মহাবৃত্তের মহাবেষ্টন।
তারই মাঝে ধর্ম-সংস্থাপনে প্রজ্বলিত
একাকী অভিমন্যু।
বুঝে গেল সে তার ভবিষ্যৎ
হয়তোবা আজই ঘটে যাবে তার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত।
নিয়তি যখন আগেই রচিত
তবে ভবিষ্যতের এই ভাবনা
যুদ্ধক্ষেত্রে নিছকই ক্ষত্রিয় চেতনার বিরোধী।
বাম হাতে তুলে নিল ধনুক,ডান হাতে শর
বিদ্যুতের গতিতে শুরু হল প্রত্যাঘাত।
শরজালে সূর্যদেবও যেন আটকে গেছেন মধ্য-গগনে।
লক্ষ যখন স্থির লক্ষ্যভেদ তখন অসম্ভব নয়।
দুঃশাসন মুর্ছিত, মহাবীর কর্ণও আহত তার শরাঘাতে।
দ্রোণ পুত্র অশ্বত্থামার ভীত পদযুগল কম্পিত।
দুর্যোধন পুত্র লক্ষ্মণ, শল্যপুত্র রুক্মরথ,কর্ণের ভ্রাতা, কোশল রাজ বৃহদবলের দেহ ছিন্নভিন্ন।
অপ্রতিরোধ্য অভিমুন্যের পরাক্রমে একে একে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রণভঙ্গে উদ্যত
কৌরব সেনা আর সেনাপতি।
এই তো কিছুক্ষণ আগেই দ্রোণাচার্যের
অভেদ্য চক্রব্যূহ ভেদ ক’রে
রণাঙ্গনের মধ্যস্থলে সে উপস্থিত।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস!
ব্যূহ ভেদ করতেই শিখেছে সে
নিষ্ক্রমণের পথ তার জানা হয়নি।
যুদ্ধে বিজয় প্রাপ্তি যখন মুল কথা
তখন সেখানে নীতির পালন নিতান্তই হাস্যকর।
এতদিনের শিষ্টের পালক দ্রোণাচার্য
ভীত হয়ে হঠাৎই হয়ে উঠলেন অশিষ্ট।
পিছন থেকে আক্রমণের আদেশ দিলেন
আদেশ দিলেন একসাথে শরক্ষেপনের।
চিৎকার করে ওঠে অভিমন্যু
“হে অস্ত্রগুরু মহামহিম দ্রোণাচার্য,
এ অন্যায়-যুদ্ধ কোথায় শিখলেন আপনি?
একজন বালকের ভয়ে আপনাকেও
ব্যাভিচারী হতে হল আজ!
এখানেই আপনি পরাজিত গুরুদেব।
ধিক আপনাকে শত ধিক।”
কিন্তু এটাই যুদ্ধ!
হঠাৎই হাতে থেকে ধনু ছিটকে গেল।
ভেঙে পড়ল যুদ্ধরথ।
সমস্ত অস্ত্র হারিয়ে ভাঙা রথের চক্র হাতে তুলে প্রতিহত করতে থাকল-
বিপক্ষের সকল সমবেত নিষ্করুণ আক্রমণ।
প্রতিহত করতে থাকল-
সকল অর্ধমের আস্ফালন।
কিন্তু কতক্ষণ!
অজস্র শরে বিদ্ধ কিশোর-বক্ষের
লাল শোণিতের ধারা বয়ে বয়ে
কুরুক্ষেত্রের পুণ্যমাটিও যেন
আর্তনাদ করে ওঠে।
গৃহের দ্বার-প্রান্তে প্রদীপ জ্বেলে তখনও
তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী উত্তরা
স্বামী ফেরার অধীর অপেক্ষায় পথ-চেয়ে।
কিন্তু ফেরা আর হলো না!
রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ল কুরুক্ষেত্রের ধুলোয়।
না, অভিমন্যু মারা যায়নি!
ধর্ম-স্থাপনে এখন সে বেঁচে ফিরছে
সুটিয়ার বরুণ বিশ্বাসদের রক্তে-রক্তে,
শিরায়-উপশিরায়।
পাপের চক্রব্যুহ ভাঙতে যারা প্রবেশ করে
প্রতিবাদের অস্ত্র হাতে।
আর তাদের পিছন থেকে এভাবেই রক্তাক্ত করে
একালের শকুনিরা।
এখনো সে বেঁচে ফিরছে কামদুনি বা
নির্ভয়ার নৃশংসতায়।
যেখানে ব্যাভিচারের করাল মূর্তিরা সমবেত হয়ে
হত্যা করে একাকী অভিমন্যুকে।
আর উত্তরা! উত্তরা এখনও পথ-চেয়ে প্রহর গোনে প্রিয়-বিয়োগের অন্তরালে
অজান্তে প্রিয়-যোগের জাল বোনে।।