প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৭ আগষ্ট : অবসর নেওয়ার তিন বছর পরেও পেনশন চালু না হওয়ায় মানসিক হতাশায় আত্মঘাতী হলেন শিক্ষারত্ন সন্মানে ভূষিত এক শিক্ষক । মৃত শিক্ষকের নাম ডঃ সুনীল কুমার দাস (৬৩)।শিক্ষকতা জীবনের শেষ লগ্নে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন । তাঁর বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মেমারি থানার দেবিপুরের রাজবাগান কলোনী এলাকায়।মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজের বাড়ির দোতলার একটি ঘর থেকে উদ্ধার হয় এই শিক্ষকের ঝুলন্ত মৃতদেহ।পেনশন না পেয়ে রাজ্যের এক শিক্ষারত্নের এমন করুণ পরিণতির কথা জেনে বিস্মিত রাজ্যের শিক্ষক মহল ।ময়নাতদন্তের জন্য বুধবার শিক্ষকের মৃতদেহ পাঠানো হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ মর্গে।পুলিশ শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে ।
দেবীপুরের রাজবাগান কলোনী এলাকায় রয়েছে শিক্ষক সুনীল দাসের পরিবারের দোতলা বাড়ি রয়েছে।সেই বাড়িতেই সুনীলবাবু ও তাঁর দাদা শংকর দাসের পরিবার বসবাস করেন । সুনীলবাবুর দুই কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে।ছেলে সমীরণ দাস অতি সম্প্রতি পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। নানা স্কুলে শিক্ষকতা করার পর সুনীল দাস কলকাতার হেয়ার স্কুল প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব গ্রহন করেন।পরবর্তী সময়ে ওই স্কুল থেকেই তিনি অবসর গ্রহন করেন।দেবীপুর এলাকাতেও রয়েছে সুনীলবাবুর অনেক ছাত্রছাত্রী। এলাকার সকল শিক্ষানুরাগী মানুষজন সুনীল বাবুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।সুনীল বাবুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সমবেদনা জানাতে এদিন তারা সকলেই সুনিলবাবুর বাড়িতে পৌছে যান।
স্বামীর এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সুনীল বাবুর স্ত্রী সাধনাদেবী। এদিন চোখের জল মুছতে মুছতেই সাধনাদেবী বলেন,’আমার স্বামী প্রকৃত অর্থেই একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি শিক্ষারত্ন সন্মানে ভূষিত হন।ওই বছরে ৫ সেপ্টেম্বর আমার স্বামীর হাতে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষারত্ন সন্মাননাপত্র তুলে দেন ।বএই পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও স্বামী শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর গ্রহনের পর পেনশন চালু না হওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়।’ সাধনাদেবী বলেন,’অবসরকালীন পুঁজি ভেঙে আমার স্বামী দুই মেয়ের বিয়ে দেন । তারপর থেকে পেনশন যাতে দ্রুত চালু হয় তার জন্য তিন বছর ধরে আমার স্বামী কলকাতার বিকাশভবনে গিয়ে বারেবারে দরবার করেছেন। কিন্তু পেনশন আর চালু হয়নি । তা নিয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছিলেন আমার স্বামী। সেই হতাশার জেরেই শেষমেষ আমার স্বামী সুনীলবাবু মঙ্গলবার বিকালে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিলেন ।’
শিক্ষক সুনীল দাসের দাদা শংকর দাস বলেন, ‘আমার ভাই সুনীল কলকাতার হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ওই স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ভাইয়ের পেনশন চালু হয়নি। পেনশন চালুর জন্য ভাই বারে বারে কলকাতার বিকাশ ভবনে দরবার করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়না ।পেনশন না পেলে সংসার কিভাবে চলাবে তা ভেবে কুলকিনারা করতে পারছিলনা ভাই । এইসব নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ আমার ভাই মনমরা হয়েছিল। দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিল।’ তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ভাই সুনীল বাড়ির দোতলার একটি ঘরে যায়। সন্ধ্যার খানিকটা আগে বৌমা সাধনা চা নিয়ে দেতলার ঘরে সুনীলকে দিতে যায় । বৌমা অনেক ডাকাডাকি করেও ভাইয়ের সাড়া পায় না। ওই ঘরের দরজা ও সমস্ত জানালা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখা ছিল । চা নিয়ে নিচের তলায় ফিরে এসে বৌমা এই ঘটনার কথা বাড়ির সবাইকে বলে । এরপর ভাইপো সহ বাড়ির সবাই দেতলায় গিয়ে ওই ঘরের দরজায় ধাক্কা লধাক্কি করে । কিন্তু ভাই সুনীলের কোন সাড়া পাওয়া যায় না ।পরে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতেই দেখা যায় গালায় নাইলনের দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় সুনীলের মৃতদেহ ঝুলছে । মেমারি থানায় খবর দেওয়া হলে পুলিশ রাতে বাড়িতে এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে ।’ এলাকার মানুষজন জানান,গ্রামে শিক্ষাবিস্তারে সুনীলবাবুর অনেক অবদান রয়েছে। লেখাপড়ার শেখার জন্য উনি অনেককে সাহায্য করেছেন। গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের বিনা পয়সায় পড়াতেন । এমন এক শিক্ষকের এই করুণ পরিণতিতে সবাই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছেন ।
এদিকে শিক্ষারত্ন সন্মান পাওয়া এক শিক্ষকের এমন মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর । বিজেপির পূর্ব বর্ধমান জেলা সহ-সভাপতি সৌম্যরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুনীল কুমার দাস হয়তো ’কাটমানি’ দেননি । তাই তার পেনশনের ফাইল দফতরেই আটকে পড়ে ছিল ।’ যদিও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রত্য বসু বলেন,’অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা । অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষকের আপদকালীন পেনশন চালুর নির্দেশ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দেওয়া হয়েছিল । তা সত্ত্বেও কেন তিনি পেনশন পাচ্ছিলেন না,কোথায় আটকালো তা বোঝার জন্য এদিনই তদন্ত কমিটি গঠন করা হল । তদন্ত কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে । রিপোর্ট আসলেই বিষয়টি বোঝা যাবে ।’।