গতকাল রাত্রি ৯ টা নাগাদ বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হিন্দু যুবক দিপু চন্দ্র দাশ (৩০)কে ধর্মনিন্দার মিথ্যা অভিযোগে নৃশংসভাবে পিটিয়ে গাছে ঝুলিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে । সেই নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে । সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বাংলাদেশের ইসলামি চরমপন্থীদের পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন । নিন্দায় সরব হয়েছেন দক্ষিণী সিনেমার সুপারস্টার ও অন্ধ্রপ্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী পবন কল্যাণও । তিনি বাংলাদেশের ইসলামি চরমপন্থীদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ।
পবন কল্যাণ ময়মনসিংহে হিন্দু যুবকের নৃশংস বর্বরোচিত হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক্স-এ লিখেছেন,’দীপু চন্দ্র দাসের আত্মার জন্য প্রার্থনা ।
ইতিহাস আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে। কিন্তু আজ, যে মাটি একসময় ভারতীয় রক্তে স্বাধীন হয়েছিল, তা নিরীহ সংখ্যালঘুদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে।’ তিনি লিখেছেন,’১৯৭১ সালে, আমাদের ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী নিপীড়িতদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের সাহসী সৈন্যরা কেবল যুদ্ধ করেনি; তারা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত লক্ষ লক্ষ মানুষের পরিচয় এবং মর্যাদার জন্য লড়াই করেছে। বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত করতে প্রায় ৩,৯০০ ভারতীয় সৈন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং ১০,০০০ এরও বেশি আহত হয়েছে। আমরা আমাদের জীবন দিয়েছি যাতে অন্যরা শান্তিতে বসবাস করতে পারে।’
পবন কল্যাণ আক্ষেপ করে লিখেছেন,’ কিন্তু আজ, “শান্তি” কেবল একটি শব্দ; নিপীড়নই বাস্তবতা। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২,৪৪২টি হিংসার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। ১৫০টিরও বেশি মন্দির ভাঙচুর এবং অপবিত্র করা হয়েছে। এগুলি কেবল অশান্তি বা এলোমেলো বিশৃঙ্খলার ঘটনা নয়; এটি একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং অস্তিত্বের অধিকারের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি ইচ্ছাকৃত, লক্ষ্যবস্তু হামলা।’
তিনি লিখেছেন,’লক্ষ্যবস্তুর ধরণ স্পষ্ট এবং নিষ্ঠুর – গত বছর, আমরা ইসকন সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে অন্যায্যভাবে কারাদণ্ড এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রদীপ ভৌমিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখেছি। এবং এখন ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। এই যুবককে কেবল হত্যা করা হয়নি; তাকে এমন এক বর্বরতার শিকার করা হয়েছে যা একবিংশ শতাব্দীকে লজ্জা দেয়। প্রতিবেদনগুলি নিশ্চিত করে যে তাকে জনসমক্ষে একটি উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে, তার দেহ গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন পৈশাচিক কাজ প্রত্যক্ষ করা মানবতা এবং আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পতনের লক্ষণ। দীপু দাসের আত্মার প্রতি আমার হৃদয় বেদনার্ত। আমি তার শান্তির জন্য প্রার্থনা করি এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জানাই, যারা এত ভয়াবহ ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে যা বোধগম্য নয়।’
তিনি লিখেছেন,’এই অঞ্চলের জনসংখ্যার বাস্তবতা এই চলমান ট্র্যাজেডির একটি শীতল প্রমাণ। ১৯৫১ সালে, হিন্দুরা জনসংখ্যার ২২% ছিল। আজ, এই সংখ্যা ৮% এর নিচে নেমে এসেছে। এটি কেবল অভিবাসন নয়; এটি একটি পদ্ধতিগত নিপীড়ন যা বিশ্ব উপেক্ষা করতে পছন্দ করে।’
পবন কল্যাণ বাংলাদেশের তদারকি সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন,’আমি বাংলাদেশের নেতৃত্বকে নিন্দার কথার বাইরে গিয়ে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদের অবশ্যই প্রতিটি হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ময়মনসিংহের ভয়াবহতার অপরাধীদের চূড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি হতে হবে যাতে দেখা যায় যে কোনও জনতা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমি বিশ্ব নেতাদের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় @UNHumanRights @UN-কে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের দুর্দশার প্রতি তাদের চোখ খোলার জন্যও অনুরোধ করছি। নির্বাচনী নীরবতা মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।’
অবশ্য তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন,’আমাদের ১৯৭১ সালের শহীদদের রক্ত শান্তির ভূমির জন্য ঝরেছিল, নিপীড়নের ভূমির জন্য নয়। আমরা চুপ থাকতে পারি না এবং থাকবও না।’
এদিকে বিগত কয়েকদিন দেশ জুড়ে ব্যাপক হিংসায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকা মহম্মদ ইউনূস অবশেষে মুখ খুলেছেন । বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এক্স হ্যান্ডেলে আজ লেখা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি : ঢাকা, ১৯ ডিসেম্বর: সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে আহ্বান জানানো হচ্ছে—কয়েকজন বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে সতর্ক থাকুন।আমরা সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, অগ্নিসংযোগ এবং জানমাল ধ্বংসের সকল কর্মকাণ্ডকে দৃঢ়ভাবে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা জানাই।
দেশের ইতিহাসের এই সংকটময় সময়ে আমরা একটি ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। যারা বিশৃঙ্খলাকে পুঁজি হিসেবে নেয় এবং শান্তির পথকে উপেক্ষা করে—এমন অল্প কয়েকজনের কারণে এই অগ্রযাত্রা আমরা কোনোভাবেই ব্যাহত হতে দিতে পারি না এবং দেব না।
আসন্ন নির্বাচন ও গণভোট কেবল রাজনৈতিক অনুশীলন নয়; এগুলো একটি গুরুতর জাতীয় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে সেই স্বপ্নের সঙ্গে, যার জন্য শহীদ শরিফ ওসমান হাদি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর আত্মত্যাগ ও স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে হলে সংযম, দায়িত্বশীলতা এবং ঘৃণা প্রত্যাখ্যানের প্রতি অবিচল অঙ্গীকার প্রয়োজন।
দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ও নিউ এজ–এর সাংবাদিকদের প্রতি আমরা বলতে চাই—আমরা আপনাদের পাশে আছি। আপনারা যে সন্ত্রাস ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তার জন্য আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। সন্ত্রাসের মুখেও আপনাদের সাহস ও সহনশীলতা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা মানেই সত্যের ওপর হামলা। আমরা আপনাদের পূর্ণ ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিচ্ছি।
ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই। নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানাই—সহিংসতা, উসকানি ও ঘৃণাকে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধের মাধ্যমে শহীদ হাদির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করুন।।
