শ্যামসুন্দর ঘোষ,কাটোয়া(পূর্ব বর্ধমান),০১ মার্চ : পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া-১ ব্লকের সরগ্রাম অঞ্চলের পুঁইনি গ্রামের পাতালেশ্বর মহাদেব স্বয়ম্ভু লিঙ্গ । ভগবান পাতালেশ্বরকে ভক্তবাঞ্ছা-কল্পতরু হিসাবে মানেন এলাকার বাসিন্দারা । জটিল রোগের নিরাময় থেকে শুরু করে বন্ধ্যা নারীর সন্তান ধারন সব বাবার কৃপায় সম্ভব হয় বলে বিশ্বাস গ্রামবাসীদের । হিন্দু বিদ্বেষী কালাপাহাড় এসেও ক্ষতি করতে পারেনি শিবলিঙ্গের । কোনও এক অলৌকিক কারনে তিনি ভয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন । আর এই কাহিনী বংশানুক্রমিক ভাবে আজও মুখে মুখে প্রচার হয়ে আসছে । এছাড়া মন্দিরের ঠিক পিছনেই রয়েছে প্রাচীন এক বেলগাছ । ওই গাছের বেলপাতা দিয়েই মহাদেবের সারা বছর পূজো হয় । পাতা ঝড়ার দিনে গাছের একপ্রান্তের সব পাতা ঝড়ে গেলেও অন্যপ্রান্তে তখন নতুন পাতা গজায় বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা । পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ঠিক কবে হয়েছিল তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেননি কেউই। তবে প্রাচীন নিয়ম মেনে আজও শ্রাবন মাসের জলাভিষেক,চৈত্র মাসে গাজন আর ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রির দিন ধুমধাম করে পূজো হয় । মেলা বসে । প্রায় সাত দিন চলে উৎসব । মঙ্গলবার শিবরাত্রি উপলক্ষে উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা । পূজো পরিচালন কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন,এবারে দু দিন যাত্রার আয়োজন করা হয়েছে । একদিন রয়েছে কলকাতার ছন্দবানীর অনুষ্ঠান । একদিন চলচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে বলে তাঁরা জানান ।
কাটোয়ার পুইনি গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে পাতালেশ্বর মহাদেবের প্রাচীন মন্দির । মন্দিরের চাতালটি রয়েছে গ্রাম থেকে প্রায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতায় । পুইনি মহামায় ক্লাবের সাধারন সম্পাদক জিতেন্দ্রলাল মাঝি জানিয়েছেন, পাতালেশ্বর মহাদেব স্বয়ম্ভু লিঙ্গ । মাটির তলা থেকে শিবলিঙ্গ উঠে আসার কারনেই এই নাম । পুরাতত্ত্ব দপ্তরের লোকজন এসে খোঁড়াখুড়ি করেও শিবলিঙ্গের অন্য প্রান্তের কোনও হদিশ করতে পারেনি । উত্তরপ্রদেশের কাশী বিশ্বনাথ,তারকেশ্বরের মন্দির ও ওড়িষ্যায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদুয়ারের উত্তর দিকে স্থাপিত পাতালেশ্বর মহাদেবের মতই পুইনির পাতালেশ্বর মহাদেব প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী । তিনি বলেন, ‘মধ্যযুগে দেবতার দেখভাল করতেন তৎকালীন রাজারা । পরে দায়িত্ব বর্তায় হুগলি জেলার পান্ডুয়া থানার জামগ্রামের বাসিন্দা জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র নন্দীর উপর । কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ার পর গ্রামবাসীরা একটি কমিটি গঠন করে পূজো পরিচালনা করে । জমিদার প্রদত্ত ১২১ বিঘা জমি রয়েছে পাতালেশ্বর মহাদেবের নামে । সেই জমি ভাগ করে দেওয়া আছে পুরোহিত-ঢাকি,গোয়ালা, নাপিত, মালি ছাড়াও বিগ্রহের নিত্যসেবার জন্য অনান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহকারীদের । আর তাতেই বাবার সারা বছর নিত্যসেবা ও বাৎসরিক পূজো পরিচালনা হয় ।’
গ্রামবাসী চিন্ময় চৌধুরী,বিপত্তারণ মাঝিদের কথায়, ‘পুইনি গ্রামের পাতালেশ্বর মহাদেব খুবই জাগ্রত । বাবার সকলের মনষ্কামনা পূরণ করেন । কাউকেই খালি হাতে ফেরান না । মন্দিরের পিছনের বেলগাছটির বয়স কয়েক হাজার বছর । কিন্তু আজ পর্যন্ত গাছের পাতা কখনও কেউ ঝড়ে যেতে দেখেনি । গাছের একপ্রান্তের পাতা ঝড়ে গেলেও অন্য প্রান্তে নতুন পাতা গজায় । পাতালেশ্বর মহাদেবের এমনই মাহাত্ম্য যে একদিন সকলের নজর এড়িয়ে ওই বেলগাছে উঠে পড়েছিল এক কিশোর । সে বিশালাকৃতির ওই গাছের মগডাল থেকে নিচে এসে পড়ে । কিন্তু তার গায়ে একটা আঁচড় লাগেনি ।’ তাঁরা আফশোস করে বলেন, ‘পুইনি গ্রামের পাতালেশ্বর মন্দির থেকে মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা সতীপীঠের দূরত্ব মাত্র ৩ কিমি । অথচ যোগাদ্যা সতীপীঠ নিয়ে প্রচার প্রসার থাকলেও আজও অবহেলার শিকার পুইনি গ্রামের পাতালেশ্বর মহাদেব । শুধুমাত্র উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যাবস্থার অভাবে কোনও শ্রদ্ধালু পুইনি গ্রামে মন্দির পরিদর্শনে আসতে চাননা । সরকারিভাবে প্রচার না থাকায় ভিন রাজ্যের শ্রদ্ধালুরা পুইনি গ্রামের পাতালেশ্বর মহাদেব সম্পর্কে কিছুই জানেন না । যদি প্রশাসনিকভাবে এই মন্দিরের প্রচার প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া হত তাহলে এলাকার প্রভূত উন্নতি হত ।’।