প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৯ জানুয়ারি : বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে আগুন ধরে যাওয়ায় পুড়ে মৃত্যু হল করোনা আক্রান্ত এক প্রৌঢ়ার। মৃতার নাম সন্ধ্যা মণ্ডল (৭২)। তাঁর বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের গলসির বড়মুরিয়া গ্রামে।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার সকাল থেকে ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে।হাসপাতাল কর্মীরাই প্রথম আগুন নেভানোর কাজে হাত লাগান । পরে খবর পেয়ে দমকলের একটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌছায়।আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখেন দমকলের আধিকারিকরা। ওয়ার্ডে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগেছে নাকি মসা মারার ধূপ থেকে বেডে আগুন ধরে গিয়েছিল তার তদন্ত শুরু হয়েছে।ঘটনা নিয়ে হাসপাতালের তরফে একটি এফআইআর করা হয়েছে ।পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে ।মৃতদেহটি এদিনই ময়নাতদন্তে পাঠানো হয় । ভিসেরা সংগ্রহে রাখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ।
বর্ধমান হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে এক রোগীনির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বেলা বাড়তেই রাজ্য জুড়ে তোলপাড় পড়ে যায় । ঘটনা নিয়ে স্বোচ্চার হয় রাজ্যের বিরোধী দলের নেতা ও বিধায়করা। তড়িঘড়ি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেয় । স্বাস্থ্য দফতরের তিন সদস্যের কমিটি হাসপাতালে আগুন লাগার ঘটনার তদন্ত করবে। জানা গিয়েছে ওই কমিটিতে রয়েছেন স্পেশাল সেক্রেটারি অনিরুদ্ধ নিয়োগী,আর জি কর হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোমনাথ দাস ও মার্সিং মেম্বার মণিকা গায়েন । পাশাপাশি বর্ধমান হাসপাতালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের সমস্ত সরকারী হাসপাতালে ’ফায়ার অডিটের’ নির্দেশও দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে ,জ্বর ও শ্বাসকষ্ট উপসর্গ থাকায় পরিবারের লোকজন গত বুধবার প্রৌঢ়া সন্ধ্যা মণ্ডলকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোভিড ওয়ার্ড অর্থাৎ রাধারানী ওয়ার্ডে ভর্তি করেন । সেখানেই তার কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ আসলে পরদিন সন্ধ্যাদেবীকে হাসপাতালের কোভিড জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত করা হয় । তাঁর অক্সিজেন চলছিল। রাতে ওয়ার্ডের বাইরে শুয়ে ছিলেন রোগীর পরিজনরা। শনিবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ সেখানেই ঘটে বিপত্তি। ওয়ার্ডের ৬ নং ব্লকের ৮০ নম্বর বেডে হঠাৎ আগুণ ধরে যায়। সেই বেডে থাকা সন্ধ্যাদেবী আগুনে পুড়ে দগ্ধ হন। তাতেই মৃত্যু হয় তাঁর।
রাধরানী ওয়ার্ডের বাইরে রাতে শুয়ে থাকা
রোগী পরিজনদের একজন হলেন মেমারির নিশিরাগড় নিবসী বাসি হেমব্রম। তিনি জানান, রাধারানী ওয়ার্ডের উল্টোদিকের সেডে তিনি শুয়েছিলেন । হঠাৎ শুনতে পান ওয়ার্ডের ভিতর থেকে “আগুন আগুন” বলে এক মহিলা চিৎকার করছেন। তেমনটা শুনেই দ্রুত তিনি ছুটে গিয়ে ওয়ার্ডে ভিতর যান। গিয়ে দেখেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভিতরের একটি বেডে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।তা দেখে ওয়ার্ডে থাকা বাকি রোগীরা ছুটে বেড়িয়ে আসছে।রোগীদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে
হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষীরা ওয়ার্ডে পৌছে আগুণ নেভায়। তারই মধ্যে আগুনে পুড়ে দগ্ধ হন প্রৌঢ়া রোগী । পরে তিনি মারা যান ।
অপর এক রোগীর পরিজন সুমিত্রা মাঝি জানান , আগুন দেখে অনেক কোভিড রোগী ভয়ে বাইরে চলে আসে।ঘটনার প্রায় আধঘণ্টা পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন হাসপাতালে আসে।তার আগেই হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরা আগুন নিভিয়ে ফেললেও প্রৌঢ়া কোভিড রোগী মারা যান । আগুন সম্পূর্ণ নিভে যাওয়ার পর দমকলের আধিকারিকরা ওয়ার্ডে আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখা শুরু করেন । দমকলের এক আধিকারিক দীপক সেন জানান,“ওয়ার্ডে একটি বেড ছাড়া অন্য কোন বেডে আগুন লাগে নি। মশার ধূপ থেকেই ওই বেডে আগুন লেগেছে বলে তাদের প্রাথমিক অনুমান ।
ঘটনার পরেই দ্রুত বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌছান প্রিন্সিপ্যাল প্রবীর সেনগুপ্ত,সুপার তাপস ঘোষ সহ অন্যা চিকিৎসকরা। বর্ধমান থানার আই সি সুখময় চক্রবর্ত্তীও একই সময়ে হাসপাতালে পৌছান । অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন ঘটনা নিয়ে।পরে প্রিন্সিপ্যাল প্রবীর সেনগুপ্ত জানান, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তের জন্য ফরেন্সিক দলকে বলা হয়েছে। এছাড়াও একটি পাঁচ সদ্যসের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা করবে”।সুপার তাপস ঘোষ জানান, “অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে এই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক ভাবে আশঙ্কা করাহচ্ছে। মৃতদেহের পাশে গ্যাস লাইটার, দেশালাই পাওয়া গিয়েছে। কোন কারণে ওই রোগীনি আগুণ ব্যবহার করেছিলেন কিনা সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে ।’
হাসপাতালে উপস্থিত থাকা মৃতার মেয়ে রানু মণ্ডল এদিন বলেন,’ মায়ের ব্যাগে থালা ও
জলের বোতল ছিল। লাইটার, দেশালাই ছিল না। তাঁরাও ওইসব মা কে দেন নি । বাড়ি থেকে শুক্রবারই মসারি এনে দিয়ে ছিলেন । তাই মশা মারার ধূপ জ্বালানোর কোন প্রয়োজনই থাকেনি ।’
বর্ধমান হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এদিন রাজনৈতিক মহলেও তোলপাড় ফেলে দেয় ।এদিন দুপুরে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বিজেপির সাত সদস্যদের প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন দুর্গাপুর পশ্চিমের বিধায়ক লক্ষ্মণ ঘরুই, বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক নীলাদ্রি শেখর দানা, বর্ধমান সদর জেলা বিজেপির সভাপতি অভিজিৎ তা সহ বর্ধমান জেলার বিজেপি নেতৃত্ব।বিধানসভার বিরোধি দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নির্দেশেই এই পরিদর্শন বলে জানান বিজেপি নেতারা। এই প্রতিনিধি দল কোভিড ওয়ার্ড পরিদর্শন করতে গেলেও দুর্ঘটনাস্থল সিল থাকার জন্য যেতে পারেননি। পরে তারা হাসপাতাল সুপারের সাথে দেখা করে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার কথা জানান । হাসপাতাল চত্ত্বরে দাঁড়িয়েই রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বিজেপির প্রতিনিধিরা। মৃতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণের দেবার দাবিও তোলেন বিজেপি নেতৃত্ব। বর্ধমান সদর জেলা বিজেপির সম্পাদক অভিজিৎ নন্দী অভিযোগ করেন, “সাংসদ কোটার দেড় কোটি টাকা খরচ করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ“।তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যের মুখপত্র তথা পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহ-সভাধীপতি দেবু টুডু বলেন,’বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল কতটা তলানিতে ঠেকেছে তার রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে । যা জানার পর লজ্জায় উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের মাথা হেট হয় গেলেও বিজেপি নেতাদের হয়নি । ওদের লজ্জা সরম নেই বলে বর্ধমান হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করতে শুরু করে দিয়েছে ।’।