এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,০৫ জানুয়ারী : বাংলাদেশে মৌলবাদীদের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে আসার পর থেকেই ভারতকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি । আর সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে ব্যাপক হারে বাংলাদেশি মুসলিমদের অনুপ্রবেশ ঘটানো । গত বছরের আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশি মুসলিমদের অনুপ্রবেশ বহু গুণ বেড়ে গেছে ভারতে । আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি বিজেপি শাসিত রসজ্যগুলি এনিয়ে সতর্ক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে । বিশেষ করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ক্রমাগত অভিযোগ করে আসছেন যে বিএসএফকে ক্যাম্প ও উন্মুক্ত সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বেশ কিছু এলাকায় জমি দিচ্ছেন না । যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ হচ্ছে । অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমরা দাবি করছেন যে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী অনুপপ্রবেশের জন্য দায়ি একমাত্র বিএসএফ । এবারে এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘খোলা চিঠি’ লিখে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের বিষয়ে তার ‘দ্বিচারিতা’ নিয়ে তুলোধুনো করেছেন শুভেন্দু অধিকারী ।
শনিবার(৪ জানুয়ারী) মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা শুভেন্দু অধিকারীর ওই খোলা চিঠির বিষয়বস্তু হল, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিএসএফ এর উদ্দেশ্যে করা দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অবমাননাকর মন্তব্যের জবাব।’ তিনি ‘রাষ্ট্রের গৌরব বিএসএফ এর মত একটি প্রতিষ্ঠানের’ উদ্দেশ্যে জনসমক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিকে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন ।
তিনি লিখেছেন, ভারতের সীমানা ১৫,১০৬.৭ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত । তার মধ্যে বহু দুর্গম এলাকা রয়েছে । তাসত্ত্বেও এই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অগাধ দেশপ্রেম দেশের সীমান্তের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।আমাদের দেশে ১৮টি সীমান্ত, রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে এবং এই প্রথম বহু বছর ধরে কোনও একজন মুখ্যমন্ত্রী কেবল ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে সৈন্যদের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করছেন। যতই দুঃসাহসী হোক না কেন, কোন চ্যালেঞ্জই সেনাদের মনোবলকে দুর্বল করতে পারেনি। যাইহোক, যখন একজন নাগরিক, বিশেষ করে একজন জনপ্রতিনিধি এবং একজন মুখ্যমন্ত্রী এই ধরনের অভিযোগ তোলেন তখন তা তাঁদের মনোবলকে দুর্বল করে দেয়।
শুভেন্দু লিখেছেন,’দেশের নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী কোনো সরকারের নয়, তাঁরা সমগ্র দেশের রক্ষক। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক আন্তঃসীমান্ত অনুপ্রবেশের জন্য আপনি যেভাবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে দায়ী করেছেন তাতে আপনার নিম্ন রুচির রাজনীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আছে, কিন্তু তাতে নিরাপত্তা বাহিনীকে জড়ানো, তাদের অপমান করা এবং নিজেদের ব্যর্থতার পুরো দায় তাদের ওপর চাপানোটা, অন্তত রাজনীতি হতে পারে না, এটি নোংরামি হিসেবেই গন্য হবে। এটা সিএপিএফ-এ কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের ৭৫ হাজার এবং বিএসএফ-এ কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের ৩৩ হাজার সেনার সাথে সারা দেশের সেনাদের জন্য সমান ভাবে অপমান জনক। আমাদের সাহসী সেনাদের সম্পর্কে এই ধরনের অবমাননাকর কথা খুবই দুঃখজনক। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হোক, প্রচণ্ড গরম হোক, প্রবল বৃষ্টি হোক অথবা জরুরি অবস্থা, দেশের সীমান্ত ও নাগরিকদের রক্ষায় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন। সেবা ও উৎসর্গের চেতনায় দিক্ষিত সেনাদের প্রতি আপনার অপমানজনক মন্তব্য দেশ চিরকাল মনে রাখবে।’
তিনি লিখেছেন,’দেশের সীমান্তের একটি বড় অংশ উন্মুক্ত, সেখানে কোনও বেড়া, প্রাচীর অথবা ঘেরা নেই। সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থাই এমন: কোথাও দুর্গম জঙ্গল, কোথাও গভীর নদী, কোথাও বা বরফের পাহাড় রয়েছে, এই সব প্রতিকূলতার কারণে সেখানে ঘেরা দেওয়া সম্ভব নয়। অনুপ্রবেশকারীরা এই সুযোগ কে ব্যবহার করে ওইসব জায়গায় ঢুকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বসবাস শুরু করে। তাহলে রাজ্য সরকারের এই বিষয়ে কি দায় ও করণীয়?’
এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে কয়েকটি প্রশ্ন করেছেন শুভেন্দু অধিকারী৷ তার প্রশ্ন হল :
যখন এই অনুপ্রবেশকারীরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢোকে, তখন কীভাবে এই অনুপ্রবেশকারীদের পরিচয়পত্র তৈরি হয়ে যায়? তাদের রেশন কার্ড কীভাবে তৈরি হয়?
পুলিশ এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা কীভাবে তাদের যাচাই করে, নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যাতে তাদের পরিচয়পত্র তৈরি করা সম্ভব হয়?
এবং যখন এই সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য বিএসএফের কার্যক্ষেত্রের পরিধি বাড়িয়ে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির করার কথা আসে, তখন আপনার সরকার কেন এর বিরোধিতা করে?’
পাশাপাশি বিএসএফ এবং সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অসহযোগিতার বিস্তারিত তথ্যও তুলে ধরেছেন শুভেন্দু অধিকারী । তিনি লিখেছেন :
আন্তর্জাতিক সীমান্ত জুড়ে রাস্তা ও বেষ্টনী নির্মাণ
২৮৪.৫৬ কিলোমিটার বেষ্টনী নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া রাজ্য সরকারের স্তরে মুলতুবি রয়েছে। ১৩৩টি জমি অধিগ্রহণের মামলাগুলির মধ্যে ৩টি রাজ্য সরকারের মন্ত্রিসভায় বিচারাধীন এবং ১০টি বিচারাধীন রয়েছে রাজস্ব রেকর্ডের অভাবের জন্য।
টাকা মুক্তি সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষে ২১৭.৮৯ কোটি টাকা প্রদান করা সত্ত্বেও মাত্র ৩১% জমি বিএসএফকে হস্তান্তর করা হয়েছে।১৮টি ক্ষেত্রে বিএসএফের কাছে কোন জমি হস্তান্তর করা হয়নি। রাজ্য সরকারের ধীরগতির জমির মূল্যায়নের কারণে ৬৩টি ক্ষেত্রে অর্থপ্রদান মুলতুবি হয়ে রয়েছে।
সীমান্ত ফাঁড়ি
মুলতুবি হয়ে থাকা ১৭টি জমি অধিগ্রহণ মামলার মধ্যে
রাজ্য সরকার অনুমোদিত ১০টি মামলার মধ্যে ৪টিতে জমি হস্তান্তর হয়নি। জমির মূল্যায়নের অভাবে ৬টি মামলা বিচারাধীন।২টি মামলা এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়, এবং ৫টি রাজস্ব রেকর্ডের কারণে বিচারাধীন।
ভূমিহীন কি লোকেশন প্ল্যান (কেএলপি)
১১টি ভূমিহীন কেএলপি’র জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের কাছে মুলতুবি হয়ে রয়েছে।
মাসিক সমন্বয় সভা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুরোধ সত্ত্বেও এই ব্যবস্থা রাজ্য সরকার প্রয়োগ করেনি।
রাজ্য পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়
কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানে পুলিশ খুব কমই অংশগ্রহণ করে। পুলিশ নিয়মিতভাবে বিএসএফ কর্তৃক আয়োজিত এলআইএ মিটিংয়ে (LIA meetings) অংশগ্রহণ করে না।
রাজ্য পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর (FIR) দায়ের করার জন্য বিএসএফ কর্মীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
সীমান্ত-সম্পর্কিত ঘটনায় নথিভুক্ত এফআইআর গুলির আপডেট বিএসএফকে দেওয়া হয় না।
আইনানুগ দায়িত্ব পালনকারী বিএসএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছে।
সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে গরুর বাজার
সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা ৮৩টি গরুর হাট, সীমান্তে গরু পাচারের উৎস।
বহুবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাদের স্থানান্তর করা হয়নি।
সীমান্ত বেষ্টনীর ওপারে গ্রাম
সীমান্ত বেষ্টনীর ওপারে ৯৫টি গ্রাম। রাজ্য সরকার তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অনুপ্রবেশ
২০২৩ সালে, বিএসএফ ১,৪৫৪ অনুপ্রবেশকারী এবং ২০২৪ সালে, ১,৭২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এদিকে রাজ্য পুলিশ এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অনুপ্রবেশকারীরা খুব সহজেই জাল আধার কার্ড পেয়ে যায়। পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আগত নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের সুবিধার্থে আনা করতে CAA আইনের বিরোধিতা করছে, কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের স্বাগত জানাচ্ছে। এক সময় সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ছিল অসমে, সেখানে কীভাবে অনুপ্রবেশ বন্ধ হল এবং কেন পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে? এর একমাত্র কারণ হল অসমের রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলে সাহায্য করেছিল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের চাপে ক্রমাগত অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাঙ্কে রূপান্তরিত করার কাজ করে চলেছে।’
সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘২০১৪ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৫৯১ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এই কাজ এখনও চলছে। মোট ১১৫৯ কিলোমিটার সীমান্তে ফ্লাড লাইট স্থাপনের দ্বারা আলোকিত করা, ৫৭৩টি সীমান্ত আউট পোস্ট নির্মাণ করা এবং ৫১০টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও, ৯টি সমন্বিত চেকপোস্ট নির্মাণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮টি বিএসএফের এবং আরও ১৪টি নির্মাণাধীন রয়েছে। সরকার জনগণ-অন্তর্ভুক্ত (people inclusive) সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নীতিও সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। মোদি সরকার অনুপ্রবেশকারীদের সনাক্ত করতে, ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দিতে এবং তাদের দেশ থেকে তাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, ভোটব্যাঙ্কের লোভে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প, সংস্কৃতি ও জনতত্ত্বকে বিসর্জন দেবেন না। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যত প্রজন্ম আপনাকে কখনই ক্ষমা করবে না।’।