প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩০ ডিসেম্বর : ঘর হোক বা রাস্তা,আবর্জনা সাফ করতে ঝাঁটাই ভরসা।তবুও এই ঝাঁটার সঙ্গে নানা লোকাচার যেমন জড়িয়ে রয়েছে তেমনি জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতি।তাই ঝাঁটাই হয়ে গিয়েছে আমআদমি পার্টির প্রতীক।এহেন ঝাঁটাই এখন আবার বাংলার যুবকদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দিশা দেখাচ্ছে।না ,এটা নিছক কথার কথা নয়।বাস্তবেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আকারে ’ঝাঁটা’ তৈরি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের পালিশ গ্রামের বাসিন্দা শেখ আব্দুস সামাদ। তবে অবশ্য শুধু ’নারকেল কাঠির’ ঝাঁটা নয়,‘নেপা কাঠি’ দিয়েও তিনি ঝাঁটা তৈরি করছেন। আর তাতেই তিনি কার্যত বাজিমাত করে ফেলেছেন।
কৃষি নির্ভর জেলা হিসাবেই রাজ্যে পরিচিত পূর্ব বর্ধমান। ’শস্যগোলা’ হিসাবেও রাজ্যে এই জেলার পরিচিতি রয়েছে। কৃষি বিনা অন্য কোন বিকল্প কর্ম পথে রোজগারের ভাবানাই যেন ভাবতে পারেন না এই জেলার বাসিন্দারা।এইরকম এক জেলার
বাসিন্দা হয়েও আব্দুস সামাদ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছেন।শুধু চাষ নয়,স্বল্প পুঁজি নিয়ে গোছা গোছা ঝাঁটা তৈরি ও তা বাজারজাত করেও যে রোজগার করা যায় সেই দিশাই তিনি দেখাতে পেরেছেন। ঝাঁটা তৈরিকরে সামাদ এখন নিজে যেমন ভালো উপার্জন করছেন,তেমনই তাঁর ঝাঁটা তৈরির কাজে শ্রম দিয়ে আরও অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বাহাত্তর বছর বয়সী আব্দুস সামাদ বলেন,’চাষের জমি আমাদের নেই বললেই চলে।তাই চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করার সৌভাগ্য আমার হয় নি। একটা সময় ছিল, যখন অভাব অনটনই ছিল আমার পরিবারের নিত্য দিনের সঙ্গী। দুটো পয়সা রোজগারের জন্যে তখন আমি বিভিন্ন ব্যক্তির দেওয়া নারকেল কাঠি দিয়ে ঝাঁটা বানিয়ে দিতাম। আমার ঝাঁটা তৈরি ভালো হত বলে খুশি হয়ে তারা একটা জাঁটা তৈরির জন্য আমায় ১০ টাকা দিতেন।
সামাদের কথা অনুযায়ী,’এভাবেই লোকের ঝাঁটা তৈরি করে দিয়ে তাঁর দিন চলছিল।তার পর একদিন তিনি ঠিক করে ফেলেন,আর লোকের ফরমাশ মনে ঝাঁটা তৈরি নয়,।এবার তিনি ঝাঁটা তৈরিকেই জীবিকা হিসাবে কাজে লাগাবেন। সেই মত প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারকেল কাঠি কিনে তিনি নিজের বাড়িতেই বেশকিছু করে ঝাঁটি তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করেন।এখনও সেটাই করছেন। তবে এখন একপ্রকার ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের আকারে ঝাঁটা তৈরি করে তা বাজারজাত করছেন বলে আব্দুস সামাদ জানিয়েছেন।
বাড়ির ফাঁকা জায়গাতে বসে তিন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে আব্দুস সামাদ এবং তাঁর বড় ছেলে শেখ কামরুজ্জামান ওরফে সাগর প্রতিদিন গোছা গোছা ঝাঁটা তৈরি করেন।সাগরের ভাই শেখ সাহেব
সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করেন। সাগর জানান, ’বছরের আশ্বিন ,কার্তিক ও অগ্রহায়ন মাসে ঝাঁটার চাহিদা বেশী থাকে।এছাড়াও আউস ,আমন ও বোরো ধান ঝাড়াই কাজ শুরু হলে ঝাটার চাহিদা বাড়ে। সেটা মাথায় রেখে তখন প্রতিদিন ৬০০ ঝাঁটা তৈরি করা হয় । বাকি বছরের অন্যান সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ঝাঁটা তৈরি করে থাকেন’।সাগর আরো জানান,’লারকেল কাঠি দিয়েই তাঁরা প্রথম থেকে ঝাটা তৈরি করছেন।তবে এ বছর নারকেল কাঠির পাশাপাশি ’নেপা কাঠি’ দিয়েও ঝাটা তৈরি করেছেন।
সাগরের দাবি,’দাম একটু বেশী হলেও ’’নেপা কাঠি’’ দিয়ে তৈরি ঝাঁটা খরিদ্দারদের কাছে যথেষ্টই গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে’। তাই নারকেল কাঠির ঝাঁটার পাশাপাশি তাঁরা ’নেপা কাঠির’ ঝাঁটাও সামান তালে তৈরির কাজ চালাচ্ছেন।সাগার এও দাবি করেন, ’তাঁদের তৈরি ঝাঁটার চাহিদা এখন মঙ্গলকোট ও শহর বর্ধমানের বাজার ছাড়াও প্রতিবেশী জেলা মুর্শিদাবাদ,নদীয়া, বীরভূমের পাশাপাশি হাওড়ার বাজারেও বেড়েছে।তাই ওইসব জেলাতেও এখন ঝাঁটা সরবরাহ করছেন’।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান ,সাগর ও তাঁর বাবার ঝাঁটা তৈরির কারবার দেখে ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকরাও প্রশংসা না করে পারেন নি।ব্লক প্রশাসন সহযোগীতা করায় সম্প্রতি সাগর ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক লোন পেয়েছেন । সাগর এও জানান,’ আরো বেশী সংখ্যায় ঝাঁটা তৈরির জন্য ব্যাঙ্ক লোনের অর্থ থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকার ঝাঁটা কাঠি কিনে তিনি বাড়িতে মজুত করেছেন ।
নারকেল কাঠি দিয়ে যে ঝাঁটা তৈরি হয় সেটা সবাই জানে। কিন্তু ’নেপা কাঠির’ বিষয়টা অনেকের কাছেই অজানা। ’নেপা কাঠি’ তাহলে কি ? এই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুস সামাদ বলেন,’ কয়েক মাস আগে হলদিয়ার এক মহাজনের কাছ থেকে তিনি
প্রচুর নেপা কাঠি কেনেন। ওই মহাজনই জানিয়ে ছিলেন ,“ইন্দোনেশিয়ার কোন গাছের পাতা থেকে মেলে এই ’নেপা কাঠি ’ । ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে লোড হয়ে দক্ষিণ ভারত হয়ে ’নেপা কাঠি’ পশ্চিম বঙ্গের হলদিয়া বন্দরে আসে । সেখান থেকেই মহাজনরা নেপা কাঠি সংগ্রহ করেন“। ’নেপা কাঠির’ সঙ্গে নারকেল কাঠির কি কোন তফাৎ আছে? এর উত্তরে আব্দুস সামাদ জানান, নারকেল কাঠির থেকে ’নেপা কাঠি ’বেশি লম্বা।’তাই নেপা কাঠি’ দিয়ে তৈরি ঝাঁটা আকারে একটু বড় হয় বলে খরিদ্দারদেরূ নজর কাড়ে। এছাড়াও যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করলেও নারকেল কাঠির ঝাঁটার চাইতে “নেপা কাঠি’ দিয়ে তৈরি ঝাঁটার কাঠির ক্ষয় কম হয়। সেই কারণে দাম বেশি হলেও খরিদ্দাররা নেপা কাঠি দিয়ে তৈরি ঝাঁটা কিনতে দ্বিধা করছেন না“ ।তাহলে দু’রকম ঝাঁটার দামে কেমন ফারাক ?তার উত্তরে আব্দুস সামাদ বলেন ,নারকেল কাঠি দিয়ে তৈরি একটা ঝাঁটার দাম আমরা ৪০ টাকা নিয়ে থাকি। আর ’নেপা কাঠি’ দিয়ে তৈরি ঝাঁটার দাম আরো ১০- ১৫ টাকা বেশি নেন।
পূর্ব বর্ধমান জেলাপরিষদের সভাধীপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার মঙ্গলকোটের পালিশ গ্রামেরই বাসিন্দা । তিনি বলেন,’আব্দুস সামাদ কে আমি খুব ভালো ভাবেই চিনি।বেশ কয়েক বছর আগে একপ্রকার শূন্য হাতেই তিনি ছোট আকারে ঝাঁটা তৈরির কারবার শুরু করেছিলেন।এখনও তিনি ঝাঁটাকে আঁকড়েই রয়েছেন।তবে এখন তার ঝাঁটা তৈরির কারবারের অনেক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে।গ্রামের শ্রমিকরাও সামাদের ঝাঁটা তৈরির প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ পাচ্ছেন।তা দেখে প্রশাসনও সামাদের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে,’নিজের উদ্যমের পাশাপাশি দিশা স্থির থাকলে যে কেউ সামাদের মতই নিজের বাড়িতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতিষ্ঠান গড়ে স্বনির্ভর হতে পারেন’।।