প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,২৬ এপ্রিল : “ভোট হিংসা“,এই কথাটার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আট থেকে আশি সকলেই বিশেষভাবে পরিচিত।তাই ভোট আসলেই ’আতঙ্ক’ পিছু তাড়া করে বেড়ায় বঙ্গের বাসিন্দাদের।অষ্টাদশ লোকসভা ভোটের সময়েও জনমনে সেই একই আতঙ্ক ঘুরপাক খাচ্ছে। ভোট ’হিংসা মুক্ত’ করতে নির্বাচন কমিশনের শত আশ্বাস ও সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর রুট মার্চ’,এসব সত্ত্বেও সাধারণ জনগণ কিছুতেই যেন ’শঙ্কা’ কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এমন আবহে নিরীহ বঙ্গবাসীর ’শঙ্কা’ কাটাতে’ হাল ধরেছেন স্বপন দত্ত নামে বর্ধমানের এক বাউলশিল্পী। ভোট ঘোষণা হওয়ার পরেই তিনি ’ভয় ও হিংসা মুক্ত’ ভোটের আবেদন সম্বলিত গান বেঁধে ফেলেন।বর্ধমান থেকে শুরু করে বঙ্গের জেলায় জেলায় গিয়ে এখন তিনি সেই গানই গেয়ে চলেছেন।গানে গানে বাউলের এমন কাতর আবেদন বঙ্গের ভোটে সত্যি কি মান্যতা পাবে! উৎকন্ঠা যেন রয়েই গিয়েছে ।লোকসভা হোক কিংবা পঞ্চায়েত বা বিধানসভার নির্বাচন,পশ্চিমবঙ্গে অশান্তিই সঙ্গী।বঙ্গে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের কথাটাই কার্যত বিলুপ্তির পথে ।বাম আমল থেকে শুরু করে বর্তমান তৃণমূল সরকারের সময়কালেও সেই একই ’ট্র্যডিশন’ চলছে।যার সত্যতা আজও জানান দেয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র(NCRB) তথ্য ভাণ্ডারে।
যে তথ্য জানান দিচ্ছে ,২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় সারা দেশে ১৬ জন রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু হয়।তারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যু হয় ৭ জনের। আহত হন বারোশোর বেশী রাজনৈতিক কর্মী।আর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় বঙ্গে ৬৯৩ টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছিল।নিহত হয়েছিলেন ১১ জন।ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর’ তথ্য অনুযায়ী,১৯ শের লোকসভা ভোট মিটে যাওয়ার পরেও হিংহা মেটেন নি।। ১৯ শে রাজনৈতিক খুনের তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলা।রাজনৈতিক হিংসার একই প্রতিচ্ছবি বঙ্গের ২০২১ শের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৩ শের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ফুটে ওঠে ।
ফের আরও একটা লোকসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গিয়েছে।আর এর পর থেকেই পূর্বেকার ভোট এবং ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনার কথা মনে পড়লেই শিউরে উঠছেন ভোটারা।কমিশন এবার রেকর্ড সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গের সাত দফার নির্বাচনই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার আশ্বাস দিয়েছে ঠিকই।কিন্তু গ্রাম গঞ্জের সাধারণ মানুষজন এতেও যেন ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
এমন আবহে সাধারণ ভোটারদের অভয় যোগাতে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও বাংলার এক জেলা থেকে আর এক জেলা চষে বেড়াচ্ছেন বাউলশিল্পী স্বপন দত্ত ।বর্ধমান শহরের খাজা আনোয়ার বেড় এলাকার বাসিন্দা স্বপন দত্ত।কেন্দ্র ও রাজ্য ,উভয় নির্বাচন দপ্তরের কাছেই তিনি পরিচিত মুখ। নিঃস্বার্থে সমাজ সচেতনতা মূলক প্রচার কাজে সামিল হওয়ার জন্য স্বপন বাউলকে প্রশংসা পত্র পাঠিয়ে ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ।এহেন স্বপন বাউল চলতি লোকসভা ভোটের সময় বঙ্গ সমাজে অহিংসার বাণী ছড়িয়ে দিতে কমিশনের অনুমতি নিয়ে কয়েকটি গান বেঁধে ফেলেছেন।
সেইসব গানের কোনটির কথা হল,“শান্তিপূর্ণ ভোট দাও -শান্তিভঙ্গ কেউ কোরো না। সন্ত্রাসমুক্ত ভোট করতে হবে,বোমাবাজি- প্রাণহাণি কেউ কোরো না,কোন মায়ের কোল শূন্য যেন কেউ কোরো না“।আবার অন্য গানের কথা হচ্ছে,’নিজের ভোট নিজে দাও-ভোট নষ্ট কোরো না। নির্ভয়ে ভোট দাও,ভোট দানে কেউ পিছু হটো না।“গেরুয়া বসন পরিহিত হয়ে ডান হাতে একতারা আর কোলে থাকা ডুগি বাম হাতে বাজিয়ে এই গান গাইতে গাইতে স্বপন বাউল পৌছে যাচ্ছেন এক জেলা থেকে আর এক জেলা।উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান,বাঁকুড়া, বীরভূম,পুরুলিয়া এমনকি রাজ্য রাজনীতিতে শিরোনামে থাকা সন্দেশখালি, কোথাও যেতে তিনি বাকি রাখছেন না।
কিন্তু ভোট তো গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব,তাহলে সেই উৎসবের সময় কেন এমন গান গাইতে হচ্ছে ? এর উত্তরে বাউলশিল্পী স্বপন দত্ত বলেন,’বিগত ভোট গুলিতে বোমাবাজি, গোলাগুলি, প্রাণহাণি, খুনোখুনি এসব আমি দেখেছি। এসব আর চাইছেন না বাংলার বাসিন্দারা। এবারের লোকসভা ভোট বাংলায় যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয় তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অতি কঠোর হতে হবে। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে হবে’।এবারতো বাংলায় ভোটের জন্য রেকর্ড সংখ্যায় কেন্দ্রীর বাহিনী থাকবে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে , তাতেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না? উত্তরে স্বপন বাউলের সটান জবাব,“আগের ভোটেও কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দেখেছি ,কেন্দ্রীয় বাহিনী শুধু দাঁড়িয়ে আছে।এবারের ভোটের দিন গুলিতে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী যাতে ঠুঁটা জগন্নাথ হয়ে না থাকে,তারা যাতে অতি সক্রিয় ভাবে কাজ করে সেটা কমিশকে দেখতেই হবে বলে স্বপন বাউল দাবি করেছেন।।