এইদিন ওয়েবডেস্ক,কলকাতা,১৩ সেপ্টেম্বর : দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন দশকের বামপন্থী শাসনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনুন্নয়ন দেখেছে ৷ দেখেছে তোষামোদি রাজনীতি ৷ শেষের দিকে কাস্তে হাতুড়ি শিবিরের ক্যাডারদের রক্তচক্ষু যা মানুষকে পরিবর্তনের জন্য এককাট্টা করে দিয়েছিল । বিকল্প হিসাবে তারা বেছে নিয়েছিল মমতা ব্যানার্জি ও তার নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেসকে । এটা বলতে দ্বিধা নেই যে ২০১১ সালের আগে থেকেই বাংলার অরাজনৈতিক নারী-পুরুষের মধ্যে মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে একটা ‘আবেগ’ কাজ করেছিল । ভারতীয় রাজনীতির এই পোড় খাওয়া নেত্রী মানুষের আবেগকে সুকৌশলে কাজেও লাগান । তাই কোনো নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালেই কখনো তাকে পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে হুইল চেয়ারে বসে প্রচার করতে দেখা যায় । কখনো কপাল ফাটিয়ে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে প্রচার করেছেন মমতা । কখনো গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রের’ ইঙ্গিত করে সুকৌশলে মানুষের আবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন । আর ওই সমস্ত ঘটনাক্রম ঘটেছে কোনো না কোনো নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালেই ।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন অব্দি মমতা ব্যানার্জিকে কেন্দ্র করে মানুষের এই আবেগ বহাল ছিল । কিন্তু তারপর থেকেই তার ক্যারিশমাটিক ইমেজ আস্তে আস্তে ঝাপসা হতে শুরু করে । আর মাত্র তিন দফার শাসনকালের মধ্যেই তা কার্যত উবে যায় । এখন মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই আবেগ আর নেই বললেই চলে । কিন্তু কেন আজ এক সময়ের এই ‘জননেত্রীর’ প্রতি আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললেন বাংলার ভোটাররা ? কারো কারোর কথায় আদপে সিপিএমের নীতি অনুসরণ করেই চলেন মমতা ব্যানার্জি । সেই তোষামোদি রাজনীতি, যা বামপন্থী দলের ‘মডিফাইড রূপ’ বলে কটাক্ষ করেন নিন্দুকরা । কিন্তু মমতা ব্যানার্জিকে সবচেয়ে বেশি ব্যাকফুটে এনে দিয়েছে দলের তৃণমূল স্তরের ক্যাডার,ছোট-বড় নেতা এবং মন্ত্রীদের সীমাহীন দুর্নীতি । তৃণমূলের প্রথম দফায় এমন পঞ্চায়েত প্রধান রয়েছেন যারা আজ কোটিপতি । এমনকি একজন পঞ্চায়েত সদস্য পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ও অনান্য সরকারি প্রকল্প থেকে ‘কাটমানি’ নিয়ে লাখ লাখ টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ । আশপাশে তৃণমূলের এমন অনেক প্রাক্তন বিধায়কও আছেন যারা মাত্র ৫ বছরের সময়কালে নিজের ছেলে-মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করা, প্রাসাদপম বাড়ি নির্মান এবং ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ ওঠে । সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাজ্যের দুর্নীতিতে লাগাম টানতে শুরু করলে পার্থ চ্যাটার্জি, অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মত তৃণমূলের প্রথমসারীর নেতাদের জেলে যেতে হয়েছে । এত দুর্নীতির পরেও ২০২৪ সালের লোকসভার ভোটে নজরকাড়া সাফল্য পায় মমতা ব্যানার্জির দল । এতে স্পষ্ট যে ভোট কমলেও কিছুটা হলেও মমতাকে নিয়ে আবেগ অবশিষ্ট ছিল মানুষের মধ্যে । তবে বিজেপির দাবি, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’- এর মত কিছু প্রকল্পের এফেক্ট এই ফলাফল ।
কিন্তু আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুনী চিকিৎসক ‘তিলোত্তমা’র ধর্ষণ বা গনধর্ষণের পর নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা রাজ্যকে । বিশেষ করে এই নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরেও আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের প্রতি মমতার ‘অপার স্নেহ’ এবং কলকাতা পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া দেখে চরম ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ । ঘটনায় মূল আসামিদের আড়াল করার জন্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে । যা ঘিরে আজও তোলপাড় চলছে গোটা রাজ্যে । ‘তিলোত্তমা’র ধর্ষণ-হত্যাকান্ডের ন্যায় বিচারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা । মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি,কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল সহ প্রশাসনিক ও স্বাস্থ্যদপ্তরের কিছু ‘বিতর্কিত’ কর্তার পদত্যাগের দাবি উঠছে । আন্দোলন এতটাই প্রবল যে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পর্যন্ত উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা । তাই এখ যেকোনো ভাবে পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের রাস্তা খুঁজছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ।
শেষ পর্যন্ত তিনি সেই পুরনো অস্ত্র ‘মানুষের আবেগ’কে কাজে লাগিয়ে উদ্ভুত এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করলেন । বৃহস্পতিবার নবান্নের সভাগৃহে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল মমতা ব্যানার্জির । কিন্তু বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং বা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে জানানো হলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক না করেই ফিরে যান আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা । আর তারপরেই নিজের পুরনো ‘টেকনিক’ প্রয়োগ করেন মমতা । সভাগৃহের সারিবদ্ধ চেয়ারের সামনে বসে ছবি তোলান তিনি এবং সেই ছবি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট করান । পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মমতা ব্যানার্জি মন্তব্য করেন,’আমাকে অনেক অসম্মান করা হয়েছে। অনেক ভুল বোঝাবুঝি, কুৎসা হয়েছে। আমি পদত্যাগ করতে রাজি আছি। কিন্তু আশা করি, মানুষ বুঝেছেন, ওঁরা বিচার চায় না। চেয়ার চায় ।’ এদিকে মমতা ব্যানার্জির এই পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ড করছে৷
যদিও বিজেপি মনে করছে যে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে মমতা ব্যানার্জি আদপে মানুষকে ‘ইমোশনাল ব্লাকমেলিং’ করা এবং ‘সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করার’ চেষ্টা করছেন । বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,’মুখ্যমন্ত্রী যে ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলেন, সেই ছবি সরকার প্রকাশ করলো আদালতকে প্রভাবিত করতে । পুরোটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক, লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আসলে ওনার মুখোশ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাই জুনিয়র ডাক্তারদের ন্যায্য দাবি মানলেন না। জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্য দফতরের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করতেন, তাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়ে যান।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পরবর্তী শুনানির আগে রাজ্যের উকিল কপিল সিব্বলের হাতে ভুয়ো যুক্তির অস্ত্র তুলে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘সিমপ্যাথি কার্ড’ ব্যবহার করছেন এই বলে যে বৈঠক হলে নাকি নির্যাতিতার জন্য নীরবতা পালন করতেন, অথচ বিধানসভায় অপরাজিতা বিল আনার সময়ে নির্যাতিতার জন্য কোনো শোকপ্রস্তাব ছিলনা।’
রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদিকা অগ্নিমিত্রা পালও একই কথা বলেছেন । তিনি বলেছেন,’মুখ্যমন্ত্রী এই দাবি করে ‘সহানুভূতি’ খেলার চেষ্টা করছেন। বিধানসভায় অপরাজিতা বিল উত্থাপনের সময়, নির্যাতিতার প্রতি কোনও শ্রদ্ধা ছিল না। আজ তিনি বলেছেন যে তিনি দুই দিন ধরে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করেছেন! কিন্তুু “অভয়ার” বাবা-মা, সহকর্মী এবং সুশীল সমাজের কী হবে, যারা ৩৩ দিন ধরে অপেক্ষা করছেন? সে সম্পর্কে কি বলার আছে আপনার মমতা ব্যানার্জী?’
কিন্তু আন্দোলনরত পড়ুয়া চিকিৎসকরা কেন সরাসরি সম্প্রচার ছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে ইচ্ছুক নন ? তারা কি মমতা ব্যানার্জির উপর আর কোনো ভাবেই ভরসা করতে পারছেন না ? এই সমস্ত প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । তবে শুধু আরজি করের আন্দোলনরত পড়ুয়া চিকিৎসকরাই নন, বহু সাধারণ মানুষ আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। এখন দেখার বিষয় যে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘ইমোশনাল কার্ড’ খেলে মমতা ব্যানার্জি জন সমর্থন কতটা নিজের দিকে টানতে পারেন ।।