মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হত্যা ভারতীয় ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিতর্কিত ঘটনা । এই হিসাবে বিতর্কিত কারন হত্যাকারী ব্যক্তি প্রবল জাতীয়তাবাদী এবং স্বধর্ম সুরক্ষিত রাখার জন্য আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন । যেকারণে আজও সেই ‘হত্যাকারী’ নাথুরাম বিনায়ক গডসেকে আজও বহু মানুষ পূজা করেন । কিন্তু তাঁর ফাঁসির পরেও পরিবারকে হিন্দু রীতি অনুযায়ী অন্তেষ্টিক্রিয়ার সূযোগ পর্যন্ত দেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৮;সালের ৩০ জানুয়ারী, যখন দিল্লির বিড়লা হাউসে একটি প্রার্থনা সভায় নাথুরাম গডসে গান্ধীকে পরপর তিনটি গুলি করে। এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যা গডসে এবং তার সহযোগীদের দ্বারা কার্যকর করা হয়েছিল। গান্ধী হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্টেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর আম্বালা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে দিল্লি থেকে আম্বালা পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছিল তার খুব কম বিবরণ প্রকাশ্যে আসে।
আসলে, নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তেকে ফাঁসি দেওয়ার পরে, তাদের কারাগারের ভিতরে গোপনে দাহ করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে করা হয়েছিল এবং এর জন্য বিশেষ নির্দেশনা আসে ‘দিল্লি’ থেকে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দল গডসে এবং আপ্তেদের মৃতদেহ দাহ করে এবং তাদের চিতাভস্ম সংগ্রহ করে। এই ছাইগুলি একটি সাঁজোয়া যানে রাখা হয়েছিল এবং ঘাগর নদীর একটি গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে তাদের দাহ করা হয়েছিল। এ সময় নিরাপত্তার জন্য পুলিশের একটি গাড়িও ছিল। প্রশাসন নিশ্চিত করেছিল যে প্রক্রিয়া চলাকালীন কোনও বহিরাগত যাতে সেখানে উপস্থিত না থাকে, যাতে ছাই কারও কাছে পৌঁছাতে না পারে। এ জন্য নদীর মধ্যে এমন একটি জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল যেখান থেকে হাড়গুলি উদ্ধার করা অসম্ভব হবে।
নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্টে-এর ক্ষেত্রেও একইভাবে ঘটেছিল যেমন ব্রিটিশরা স্বাধীনতার আগে সর্দার ভগৎ সিং এবং তার সঙ্গীদের সাথে করেছিল। ব্রিটিশ প্রশাসন গোপনে তাদের মৃতদেহ সতলুজ নদীর তীরে দাহ করে এবং অর্ধপোড়া হাড় নদীতে ফেলে দেয়। নাথুরাম গডসের ক্ষেত্রেও একই রকম গোপন ও দ্রুত সিদ্ধান্ত দেখা গেছে। এই প্রক্রিয়াটি দেখায় যে স্বাধীন ভারতের প্রশাসন ব্রিটিশ সরকারের পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, যা একটি বিড়ম্বনা। এমন আদেশ কে দিতে পারে? যার সরকার ছিল এবং সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। তাই এই নির্দেশ যে নেহেরুই দিয়েছিল সেটা স্পষ্ট৷ আর মানসিকতার দিক থেকে জওহরলাল নেহেরু এবং ব্রিটিশদের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর উপর প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর প্রশাসন কি এই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে গডসের মামলাটি ব্রিটিশদের মতোই কঠোরতার সাথে মোকাবেলা করেছিল ?
যাইহোক, দিল্লি থেকে প্রাপ্ত আদেশ অনুসারে, নাথুরাম গডসের শেষ ইচ্ছাকে সম্মান করার জন্য স্বাধীন ভারতে কোনও প্রচেষ্টা করা হয়নি, বরং এটিকে দমন ও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। যদিও ‘অত্রি’ নামের হিন্দু মহাসভার এক কর্মী একটা ভালো কাজ করেন, যিনি গডসেজির মৃতদেহকে অনুসরণ করেছিলেন এবং তার মৃতদেহের আগুন নিভে গেলে তিনি একটি বাক্সে তার ছাই সংগ্রহ করেন । গডসেজির হাড়গুলো এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে।
১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর, যখন নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তেকে ফাঁসিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের এক হাতে শ্রীমদভগবদগীতা এবং অখন্ড ভারতের মানচিত্র এবং অন্য হাতে গেরুয়া পতাকা ছিল। ফাঁসির আগে তিনি ‘নমস্তে সাদা বাৎসল্যে’ আবৃত্তি করেন । আজও গডসেজির চিতাভস্মের ছাই সংরক্ষিত আছে। প্রতি বছর ১৫ ই নভেম্বর, গডসে সদনে একটি অনুষ্ঠান হয়, ৬ থেকে ৮ টা পর্যন্ত যেখানে তাঁর মৃত্যুর আগের লেখা নোট পাঠ করা হয়।
নাথুরাম গডসের শেষ ইচ্ছা ছিল তার ছাই সিন্ধু নদীতে নিমজ্জিত করা হোক। তবে তার ইচ্ছা এখনো পূরণ হয়নি। পুনের শিবাজি নগর এলাকার একটি অফিসে গডসের ছাই রাখা হয়েছে। অফিসের মালিক এবং গডসের ভাইয়ের নাতি অজিঙ্কা গডসের মতে, সিন্ধু নদীতে ছাই বিসর্জন তখনই হবে যখন তাঁর অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন পূরণ হবে। নাথুরাম গডসের ভাইঝি হিমানি সাভারকারের মতে, তাঁর ছাই সিন্ধুতেই নিমজ্জিত করা হিবে,তাতে যদি ৩-৪ প্রজন্ম সময় নেয় নেবে ।
কথিত আছে যে ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর গডসের ফাঁসি হওয়ার একদিন আগে, তাঁর পরিবার তাঁর সাথে দেখা করতে আম্বালা জেলে গিয়েছিল। গডসের মেয়ে, ভাইঝি এবং গোপাল গডসের মেয়ে হিমানি সাভারকার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ফাঁসির একদিন আগে তিনি তার মায়ের সাথে দেখা করতে আম্বালা জেলে গিয়েছিলেন। তখন তার বয়স আড়াই বছর।
গ্রেফতারের পর, নাথুরাম গডসে গান্ধীর ছেলে দেবদাস গান্ধী (রাজমোহন গান্ধীর পিতা) কে চিনতে পেরেছিলেন যখন তিনি গডসের সাথে দেখা করতে থানায় পৌঁছান । এই বৈঠকের কথা নাথুরামের ভাই এবং সহ-অভিযুক্ত গোপাল গডসে তাঁর ‘গান্ধী বধ কিঁউ‘ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। গোপাল গডসে তার বইয়ে লিখেছেন,’দেবদাস হয়তো এই আশায় এসেছিলেন যে তিনি গান্ধীর রক্তের পিপাসু, ভয়ঙ্কর মুখের একজন খুনিকে দেখতে পাবেন, কিন্তু নাথুরাম ছিলেন সহজ-সরল এবং ভদ্র। তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট ছিল,দেবদাস যা ভেবেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত ।’
নাথুরাম দেবদাস গান্ধীকে বললেন,’আমি নাথুরাম বিনায়ক গডসে। আজ তুমি তোমার বাবাকে হারিয়েছ। আমার কারণে তুমি কষ্ট পেয়েছ। আপনি এবং আপনার পরিবারের জন্য যে ব্যথা হয়েছে তার জন্য আমিও খুব দুঃখিত। আমি কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভের জন্য এটি করিনি, আপনার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ বা কোনো খারাপ অনুভূতি নেই।’ দেবদাস তখন জিজ্ঞাসা করিল,’তাহলে কেন এমন করিলে?’ জবাবে নাথুরাম বলেছিলেন,’কেবল এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে।’ নাথুরাম দেবদাসকে তার পক্ষ উপস্থাপনের জন্য সময় চাইলেন কিন্তু পুলিশ তাকে তা করতে দেয়নি।
এই মামলার শুনানির সময়, গডসে আদালতে স্বীকার করেছিলেন যে তিনিই গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। তার পক্ষ উপস্থাপন করে গডসে বলেছিলেন,’গান্ধীজি দেশের জন্য যে সেবা করেছেন আমি তাকে সম্মান করি। তাই গুলি চালানোর আগে আমি তাঁর সম্মানে মাথা নত করেছিলাম, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মহাত্মারও জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে শ্রদ্ধেয় মাতৃভূমিকে ভাগ করার অধিকার নেই। গান্ধীজি প্রতারণা করে দেশকে টুকরো টুকরো করেছিলেন। কারণ এমন কোনো আদালত ও আইন ছিল না যার ভিত্তিতে এমন একজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যায়, তাই আমি গান্ধীকে গুলি করেছিলাম।’নাথুরাম আদালতে তার বিবৃতি দিয়েছিলেন,যা আদালত নিষিদ্ধ করেছিল, তবে এখন সবকিছু বই আকারে বেরিয়ে এসেছে এবং গোটা বিশ্ব গডসের বক্তব্য পড়েছে, বুঝেছে এবং জানে।
যাইহোক, ভারতীয় ইতিহাসে নাথুরাম গডসের নাম সর্বদা একটি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসাবে থাকবে। তাঁর কাজ, আদর্শ এবং তাঁর শেষ মুহূর্তের গল্প ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর চিহ্ন রেখে গেছে। গডসের দাহের গোপন প্রক্রিয়া এবং তার ছাইয়ের রহস্য দেখায় যে প্রশাসন এই বিষয়ে কীভাবে সর্বোচ্চ যত্ন নিয়েছিল।।
★ ওপি ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের অনুবাদ