ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ-এর মত ভারতে অনেক বীরাঙ্গনা ছিলেন যাদের অনন্য কীর্তি ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত । তাদের বীরত্বের গৌরবজ্জ্বল সেই অধ্যায়কে স্বাধীন ভারতের ব্রিটিশ ও পরে জহরলাল নেহেরু সরকার সুপরিকল্পিত ভাবে ভুলিয়ে দিয়েছে । ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ইতিহাসকার সেই কাহিনী লিপিবদ্ধ করায় কিছু বীরাঙ্গনাদের কাহিনী আজ আমরা জানতে সক্ষম হই । এমনই এক বীরাঙ্গনা রানি হলেন চালুক্য সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী রানি নাইকি দেবী । তিনি মহম্মদ ঘোরিকে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন । কেউ কেউ দাবি করে নারী লোলুপ ঘোরির লিঙ্গ নিজের তরবারী দিয়ে ছিন্ন করে নাইকিদেবী তাকে নপুংসক করে দিয়েছিলেন । রক্তাক্ত ঘোরি প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায় । উদারতা দেখিয়ে, রানি নাইকিদেবী ঘোরিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল তাঁর মারাত্মক ভুল । কারন সেদিন নাইকিদেবী যদি ঘোরিকে না ছেড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই খতম করে দিতেন তাহলে হয়ত আজ ভারতের চিত্র অন্যরকম হত । যাই হোক, বীরাঙ্গনা রানি নাইকিদেবীর কাহিনি তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
গোয়ার কদম্বরাজা মহামণ্ডলেশ্বর পরমাদীর কন্যা ছিলেন নাইকিদেবী। ঘোড়সওয়ারি, ধনুর্বিদ্যা, অসিবিদ্যা ও মল্লযুদ্ধ। প্রায় সমস্ত যুদ্ধরীতিতেই দক্ষ প্রশিক্ষণ ছিল তাঁর। গুজরাটের আনাহিল্লাপত্তনার সোলাঙ্কি শাসক রাজা অজয়পালের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। রাজা অজয়পাল বেশি দিন সাম্রাজ্য চালাতে পারেননি। সিংহাসনে বসার চার বছরের মাথায় ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। পাঁচ বছরের ছেলে দ্বিতীয় মুলরাজকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য পরিচালনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন সাম্রাজ্ঞী নাইকিদেবী ।
১১৯১ সালে প্রথম তরাইয়ের যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে হার হয়, মহম্মদ ঘোরির সেনার। ১১৯২ সালে পুরনায় ঘোরি আক্রমণ চালায় এবং হার হয় পৃথ্বিরাজ চৌহানের। পতন হয়, দিল্লির শেষ হিন্দু রাজার। এই ইতিহাস অনেকেরই জানা।
যদিও, এই ইতিহাসের আগে আরও একটি ইতিহাস আছে। সেটি ১১৭৮ সালে। সেই সময় মহম্মদ ঘোরি অভিযান চালায় গুজরাটে এবং তাকে হারিয়ে দেন নাইকি দেবী। কাহিনির শুরু হয়, ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে। তরুণ মহম্মদ শাহাবুদ্দিন ঘোরি আফগানিস্থানে গজনভির উপর হামলা চালিয়ে রাজ্য দখল করে।
মহম্মদ ঘোরি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক ছিল। তিনি সেটাই করেছিলেন, যেটি আলেকজান্ডার, মহম্মদ গজনী করেননি। ভারতের সীমান্ত পার করে, একদম ভারতের বুকে অভিযান চালানো। মহম্মদ ঘোরির প্রথম অভিযান ছিল, মুলতান ও উচ্চার কেল্লাতে। মুলতান ও উচ্চা দখল নেওয়ার পর ১১৭৮ সালে দক্ষিণ রাজপুতানা ও গুজরাতের উদ্দেশে অভিযান চালায় ঘোরি। সেই সময় গুজরাটে চালুক্য বংশ রাজত্ব করছে।
ঘোরির মূল লক্ষ্য ছিল আনহিলওয়াড়া, অধুনা গুজরাটে পাটন দুর্গ যেখানে আছে। অষ্টম শতকে চপোতকতা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বনরাজের দুর্গ ও রাজধানী ছিল আনহিলওয়াড়া পাটনে। সেখানেই ছিল চালুক্যের রাজধানী। এই চালুক্যদের হাতেই, এখানে চপোতকতা বংশ শেষ হয়। আমেরিকার ঐতিহাসিক গবেষক টার্টাইস চান্ডেলারের মতে, পাটন এলাকা, ১০০০ খ্রিস্টাব্দের সময় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শহরের মধ্যে অন্যতম ছিল। সেই সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ। মহম্মদ ঘোরি যখন আনহিলওয়াড়ায় হামলা চালায় তখন চালুক্য সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন দ্বিতীয় মুলরাজ। যদিও পুরো শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করছিলেন নাইকিদেবী। ঘোরি জানতে পারে, রানি রাজ্য সামলাচ্ছে আর নাবালক রাজা সিংহাসনে বসে। ঘোরি আত্মবিশ্বাসী ছিল, এই রাজ্য দখল করতে তার বেশি সময় লাগবে না।
কিন্তু ঘোরি জানতো না যে নাইকি দেবী রাজ্য পরিচালনাতেও যেমন কৌশলী ছিলেন, তেমন রণকৌশলেও দক্ষ। রানি গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পান, ঘোরি মরুভূমি পার করে আনহিসওয়াড়ার দিকে এগিয়ে আসছে আক্রমণের জন্য। পাশাপাশি তার কাছে বেশ বড় সেনা রয়েছে। এই খবর পাওয়ার পরেই, রানি নাইকিদেবী, আশেপাশের রাজ্যের সমস্ত রাজার কাছে বার্তা পাঠান, সহযোগিতার। সেখানে পৃথ্বিরাজ চৌহানও ছিলেন। সেই সময় কোনও রাজ্য সেভাবে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু চালুক্যের শুভাকাঙ্ক্ষী কিছু রাজ্যের রাজা সাহায্য করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম, নবদুল্লা চহামানার শাসক কেলহনদেবা, জালোর চাহামনার শাসক কীর্তিপাল, অর্বোদ পারমারার শাসক ধারাবর্ষার শাসক সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
মহম্মদ ঘোরি মাউন্ট আবুর কাছে, কায়দারাতে ছাউনি ফেলে। চালুক্য সাম্রাজ্যের কাছে দূত পাঠায়। বার্তায় জানানো হয়, যদি রানি তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে তারা হামলা ও লুঠপাট চালাবে না। পাশাপাশি, চালুক্য সাম্রাজ্যের সমস্ত সোনা ও মহিলাদের যেন তাঁদের কাছে পাঠানো হয়। এটা রানী
নাইকি দেবীর কাছে ছিল খুব অসম্মানজনক শর্ত । তিনি ওই আফগান হানাদারকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন । তবে রানি জানতেন যে ঘোরির বড় সেনাকে হারানো সম্ভব নয় । কারন ঘোরির সৈন্যবাহিনী ছিল দেড় লাখ, এবং একটি সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী । তাই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, তিনি যুদ্ধের রণকৌশল সাজাতে থাকেন। রানি যুদ্ধস্থল হিসেবে এক অদ্ভুত জায়গা নির্বাচন করেন। মাউন্ট আবুর পাদদেশে কাসারদা গ্রামের পাশের একটি ক্ষেত্রে। বর্তমানে জায়গাটি রাজস্থানের সিরোহি জেলায় অবস্থিত। এই অঞ্চলকে গদরঘাট্টা বলা হয়। ছোট ছোট পাহাড়ি এলাকায় পাকদণ্ডি রাস্তা রয়েছে, ঘোরি বাহিনীর কাছে অনুকূল ছিল না। এই ক্ষেত্র নির্বাচনেই নাইকিদেবী যুদ্ধের ৮০ শতাংশ জয় করে নেন। পাহাড়ের কোনায় কোনায় ছোট ছোট সেনার দলকে পাঠিয়ে দেন নাইকিদেবী । কিছু সেনাকে ভিড়িয়ে দেন ঘোরির সেনাবাহিনীতে । ঘোরি যখন বাহিনী নিয়ে কাসারদা পৌঁছোয়, তখন তার সামনে পীঠে সন্তানকে নিয়ে রণমূর্তিতে দাঁড়িয়ে নাইকিদেবী । ঘোরি সেনার মধ্যে এবং পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা সোলাঙ্কির রানীর বাহিনী একযোগে হামলা চালিয়ে দেয় । ভায়ানক হার হয় ঘোরির। রানির বিশাল হস্তিবাহিনীর কাছে মহম্মদ ঘোরির বহু সেনা মারা যায় । রানী নাইকিদেবী তরবারির কোপে ঘোরির লিঙ্গ শরীর থেকে ছিন্ন করে তার অসম্মানজনক শর্তের প্রতিশোধ দেন । ঘোরি রকাক্ত অবস্থায় যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করে । কিন্তু হিন্দু রীতি মেনে রানী নাইকিদেবী পিছু থেকে তার উপর হামলা চালাননি, তাকে পালাতে দিয়েছিলেন । এটাই ছিল রানীর ভুল । কারন কাসারদার যুদ্ধে রানী নাইকিদেবী যদি যুদ্ধক্ষেত্রেই ঘোরিকে হত্যা করতেন তাহলে ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা হত না ।
যাই হোক,যুদ্ধের পর ৩০ হাজার মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, যাদেরকে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লুট করা হয়েছিল, অথবা সৈন্যদের বিনোদনের জন্য ২ দিরহাম দিয়ে কেনা হয়েছিল এবং বালখ বুখারার বাজারে বিক্রি করা হয়েছিল। বড় বড় সর্দারদের দাড়ি কামিয়ে হিন্দুতে পরিণত করা হয় এবং বাকি সৈন্য ও চাকরদেরকে কলি, খন্ত বাবরিয়া ও মের প্রজাদের মধ্যে আত্তীকরণ করা হয় । এদিকে শোচনীয় পরাজয়ের পর দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর ভারত আক্রণের চিন্তা মাথায় আনেনি ঘোরি । পরেও,ঘোরি ভারতে যখন আক্রমণ চালায়, তখন গুজরাটের বদলে পাঞ্জাবের দিকে নজর দেয়। পরের বার খাইবার পাস দিয়ে উত্তর ভারতে প্রবেশ করে। এই একই রুট ধরে আলেকজান্ডার এবং মহম্মদ গজনীও এসেছিল। ১৩৮৩ সালে তৈমুর লঙ ও একই রুট ধরে ভারতে আসে।
কাসারদার যুদ্ধ নিয়ে, বহু পুরনো নথি রয়েছে। তবে সবথেকে বেশি জানা যায় ১৪শতকের জৈন পুঁথি মেরুতুঙ্গাতে। ইতিহাসের আলোতে যদি দেখা যায়, রানিলক্ষ্মীবাঈ, রানি তারাবাঈ, রানি চেনাম্মার মতোই বীরাঙ্গনা, সাহসী ও অদম্য শৌর্যের উদাহরণ রানি নাইকিদেবী । অবশ্য আফগান হানাদার ঘোরির মৃত্যু হয়েছিল এক হিন্দু রাজার হাতেই । খোখর জাট সম্প্রদায়ের বীর যোদ্ধা রামলাল খোখর ১৫ মার্চ ১২০৬ তারিখে মহম্মদ ঘোরির শিরচ্ছেদ করেন ।।