প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৪ জানুয়ারী : চারপাশে সবুজে ভরা খেত জমি। তারাই মাঝে কোনরকমে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা ফুটো একচিলতে কুঁড়ে ঘর ।প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যে সেই কুঁড়ে ঘর থেকে ভেসে আসে শিশু পুত্র অভিষেক সানার মায়াবী কন্ঠে ভরা লোক গানের সুর । ‘নিথুর প্রেম ভিখারি করেছে মোরে’। মা হারানো অভিষেকের গাওয়া এই গানের সুর মূর্ছনাতেই মোহিত পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলের আট থেকে আশি সকলে ।মায়াবী কন্ঠে ভরা গানের জাদুতেই একরত্তি ছেলে অভিষেক গ্রামের সকলের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে।বড়শুলের সকল বাসিন্দাই মনেপ্রাণে চান দিন দরিদ্র পরিবারের ছেলে অভিষেক বড় হয়ে নামজাদা বাউল কিংবা লোকগানের শিল্পী হোক।অভিষেকও সেই স্বপ্নকে আঁকড়েই নিজেদের কুঁড়ে ঘরে নিত্যদিন রেওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছে ।
বর্ধমান সদর ২ ব্লকের বড়শুল ২ পঞ্চায়েতের
প্রত্যন্ত গ্রাম বালিমাঠ।এই গ্রামের চারপাশে থাকা খেত জমির মাঝেই রয়েছে ছিটেবেড়া আর খড়ের চালার তৈরি অভিষেকদের কুঁড়ে ঘরটি। ’নিজভূমি নিজগৃহ’ প্রকল্পে পাওয়া জায়গায় গড়েতোলা ভাঙা ফুটো সেই ঘরেই ৯ বছর বয়সী অভিষেক ও তাঁর ছোট ভাই সহ বাবা,বৃদ্ধা ঠাকুমা ও পিসি বসবাস করেন ।জায়গা মিললেও এখনও পাকা বাড়ি তাঁদের
মেলেনি । অভিষেকের যখন ৪ বছর বয়স তখন তাঁকে ও তাঁর ছোটভাই কৌস্তভ কে বাড়িতে ফেলেরেখে গায়েব হয়েযান মা ভারতীদেবী ।অভিষেকের বাবা তারকচন্দ্র সানা বালি খাদানে শ্রমিকের কাজ করে যৎসামান্য যা রোজগার করেন তা দিয়েই তাঁদের দিন গুজরান হয়।অভিষেক বড়শুল নিম্নবুনিয়াদি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ।তাঁর ভাই কৌস্তভ একই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর পড়ুয়া ।বাড়িতে বিদ্যুৎতের বাতির আলোয় পড়াশুনা করার সৌভাগ্যও এখনও তাঁদের হয়নি। ।সন্ধ্যা নামলেই লম্ফ অথবা হারিকেনের আলোই ভরসা অভিষেকদের ।তবে কষ্টের সংসারে অভিষেকই গানের সুরে সবার মন ভুলিয়ে রেখেছে ।
শুনুন খুদে শিল্পির গান :
তারকচন্দ্র সানা জানিয়েছেন ,তিনি গান বাজনা ভালো বাসেন। বাউল ও লোকগান শোনার টানে আগে তিনি বীরভূমে ’জয়দেবের মেলায় যেতেন’ ।তখন ছোট্ট অভিষেককেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন ।জয়দেব মেলায় হাজির হওয়া বাউল ও লোকগানের শিল্পীদের গাওয়া গান শুনে অভিষেকেরও গান গাওয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় ।প্রথমদিকে সে বাড়িতেই গুনগুন সুরে গান গাইতে।তা দেখে অভিষেককে একটা হারমোনিয়াম কিনে দেয় ওয় মামারা। হারমোনিয়াম পাবার পর প্রথম প্রথম অভিষেক নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতো। বছর দুই হল বড়শুল নিবাসী
মঙ্গল কালিন্দী মহাশয় কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে গান শেখাচ্ছেন অভিষেককে । মঙ্গলবাবু নিজেই গান লিখে গানের সুর দেন । সেই গানই এখন গেয়ে অভিষেক বড়শুলবাসীর মন জয় করে নিয়েছে । পাশাপাশি অভিষেক তাঁর নিজের ছোট ভাই কৌস্তবকেও একটু একটু করে গানের তালিম দিচ্ছে ।
খুদে শিল্পী অভিষেক জানিয়েছে,’বাবার হাত ধরে সে জয়দেবের মেলায় যেত । সেখানে বাউল ও লোকগানের শিল্পীদের গাওয়া গান শুনেই সে গান গাওয়ার ব্যপারে অনুপ্রাণিত হয় । অভিষেক এও জানায়, বাউল ও লোকগান শেখার প্রতিই তাঁর টান বেশী ।বড় হয়ে স্বনামধন্য বাউল গানের শিল্পী হতে চায় বলে অভিষেক জানিয়েছে । মঙ্গল কালিন্দী বলেন,তাঁর ছাত্র অভিষেকের প্রতিভা রয়েছে । গান গেয়ে এত ছোট বয়সে ও যে ভাবে সবার মন জয় করেনিয়েছে সেটাই সব থেকে গৌরবের বলে মঙ্গলবাবু দাবি করেছেন । এলাকার বাসিন্দা নয়ন মণ্ডল বলেন,’মায়াবী কন্ঠে ছোট্ট অভিষেকের গাওয়া গান তাঁদের মুগ্ধ করে । অভিষেকের গাওয়া গানের সুর মর্ছনাতেই এখন মোহিত বড়শুলবাসী। দূর দূরান্তের
সংগীত প্রেমিরাও অভিষেকের কন্ঠে গান শুনতে এখন তাদের কুঁড়ে ঘরে হাজির হচ্ছে ।’ বর্ধমান ২ ব্লকের বিডিও সুবর্ণা মজুমদারও ছোট্ট অভিকের গাওয়া গান শুনে মুগ্ধ । জানা গিয়েছে, তিনি অভিষেক ও তাঁর পরিবারকে সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন ।
অভিষেকের প্রতিভার কথা শুনে যারপরনায় মুগ্ধ বিশিষ্ঠ বাউল গান শিল্পী তথা অমৃত বাউল লোকগান প্রসার সমিতির রাজ্য সম্পাদক মণিমোহন দাস । তিনি জানিয়েছেন,অভিষেকের বাবা চাইলে তিনি সহ তাঁদের সংগঠনের অন্য শিল্পীরাও বিনা পারিশ্রমিকে অভিষেক কে গান শেখাতে রাজি রয়েছেন । তবে অভিষেকের বাড়ি গিয়ে হয়তো গান শেখানো সম্ভব হবেনা।অমৃত বাউল লোকগান প্রসার সমিতির আখড়ায় এসে অভিষেককে গান শিখতো হবে। অভিষেককে দিয়ে বড় ফাংশানে গান গাওয়ানোর ব্যাপারেও প্রয়োজনে উদ্যোগ নেবেন বলে মনিমোহন দাস জানিয়েছেন ।।