প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,১৪ ডিসেম্বর : নয়ানজুলিতে পড়ে থাকা পচাগলা মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য সামান্য একটা ’ট্যাটু’ই ছিল একমাত্র সূত্র ।তবে হাল ছাড়েনি পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। সেই ট্যাটুর সূত্রধরে তদন্ত চালিয়ে খুনের ঘটনার কিনারা করা পুলিশের পাকড়াও করা অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল বর্ধমান আদালত । সাজাপ্রাপ্তর নাম বাপ্পাদিত্য পান। হুগলি জেলার গোঘাট থানার বেলুন গ্রামে তার বাড়ি।
পরকীয়ায় বাধা পেয়ে প্রেমিকার স্বামীকে শ্বাসরোধ করে খুনের দায়ে শুক্রবার বাপ্পাদিত্য পানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন বর্ধমান আদালতের প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টর বিচারক দেবাঞ্জন ঘোষ।এছাড়াও খুনের কারণে ২০ হাজার টাকা ও প্রমাণ লোপাটের জন্য সাজাপ্রাপ্তকে ৫০০০ টাকা আর্থিক জরিমানার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। জরিমানার টাকা না মেটালে অভিযুক্তকে আরও ছ’মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। মৃতের স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবশ্য খুনে এবং প্রমাণ লোপাটে জড়িত থাকার তেমন তথ্য মেলেনি।ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়েও অকাট্য প্রমাণ না মেলায় মৃতের স্ত্রীকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করেছেন বিচারক। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন সাজাপ্রাপ্তের আইনজীবী।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর সকালে পূর্ব বর্ধমানের মাধবডিহি থানার নন্দনপুর ঢালে নয়নজুলির পাশ থেকে এক ব্যক্তির বস্তাবন্দি পচাগলা দেহ উদ্ধার হয়। স্থানীয় এক বাসিন্দার কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। মৃতের ডান হাতের কব্জির উপরে উল্কিতে তাপসী লেখা ছিল। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট মেলার পর মাধবডিহি থানার ঘুষ্টিয়ার বাসিন্দা শেখ আসরুজ্জামান থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে খুন ও প্রমাণ লোপাটের ধারায় মামলা রুজু করে তদন্তে নামে পুলিশ।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, দেহটি গোঘাট থানা এলাকার পানপাতা গ্রামের বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী খোকন মাঝি-র। পুলিশ আরও জানতে পারে, মাধবডিহি থানার উচালনের তাপসী মাঝির সঙ্গে ১৬ বছর আগে খোকনের বিয়ে হয়। খোকন পেশায় দিনমজুর ছিলেন। তাঁর দু’টি মেয়ে রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিনআগেই বড় মেয়ের বিয়ে হয়। বাপ্পার সঙ্গে খোকনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। বাপ্পা বালিখাদের ম্যানেজার ছিলেন। খোকনের বড় মেয়ের বিয়েতে খোকন আর্থিক সাহায্য করেছিল। খোকনের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল। বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে বাপ্পার সঙ্গে খোকনের স্ত্রী তাপসী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি খোকন মেনে নিতে পারেননি। এনিয়ে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে হামেশাই অশান্তি হতো।বাপ্পার সঙ্গে মেলামেশা না করার জন্য স্ত্রীকে বলেছিলেন খোকন। বাপ্পাকেও স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়ার কথা বলেছিলেন তিনি। এরপরই পথের কাঁটা খোকনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে বাপ্পা। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দুর্গাপুজোর দশমীর দিন বাপ্পার গ্রামে জলসার আয়োজন হয়। সেদিন মদ খাওয়ার সময় স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে খোকনের সঙ্গে বাপ্পার তীব্র বচসা বাধে। এরপর খোকনকে মারধর করে বাপ্পা। তারপর গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে বাপ্পা খুন করে খোকনকে । প্রমাণ লোপাটের জন্য মৃতদেহটি বস্তাবন্দি করে সাইকেলে চাপিয়ে নন্দনপুর ঢালে নয়নজুলির পাশে ফেলে রেখে যায় বাপ্পা। গামছা এবং তার সাইকেলটি উদ্ধার করে পুলিশ। তাপসী এবং বাপ্পা গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জেলেই ছিল।
এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে মৃতের ছোট মেয়ে বর্ষা মাঝি আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে জানায়, বাপ্পার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তার মায়ের সঙ্গে বাবার হামেশাই অশান্তি হতো। দু’জনকে আপত্তিকর অবস্থায় সে এবং তার বাবা দেখে ফেলেছিল। তার মাকে বাপ্পার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার জন্য বাবা অনেকবার বলেছিল। সাক্ষীদের বয়ানে খোকনের বড় মেয়ের বিয়েতে বাপ্পার আর্থিক সাহায্যের বিষয়টিও উঠে এসেছে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন,নয়ানজুলি থেকে উদ্ধার হওয়া পচাগলা মৃতদেহে সনাক্ত করণে ভরসা বলতে ছিল শুধু একটা ট্যাটু। সেই ট্যাটুর সূত্রধরে তদন্ত চালিয়ে তদন্তকারি পুলিশ অফিসার ব্রজগোপাল হালদার এই খুনের ঘটনার কিনারা করেন। বিচারক অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন ।।