মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী,জহরলাল নেহেরুর মত মহম্মদ আলি জিন্নাহর জীবনের এমন অনেক অন্ধকার দিক আছে যা আজও বহু মানুষের অজানা । স্বভাবে চরম সাম্প্রদায়িক জিন্নাহের এমনই এক অজানা কাহিনী হল, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ধনী পার্সি ব্যবসায়ী স্যার দিনশ পেটিট-এর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা । বাড়ি যাতায়াতের সূত্রে বন্ধুর ১৬ বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে লাভ জিহাদে ফাঁসিয়েছিলেন পাকিস্তানের “রাষ্ট্রপিতা” ৪২ বছর বয়সী জিন্নাহ । মেয়েটিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে ১৯১৮ সালের ১৯শে এপ্রিল ইসলামি রীতিতে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এটাই ছিল ভারতে প্রথম “লাভ জিহাদ”-এর ঘটনা ।
ইরানের বাসিন্দা স্যার দিনশ পেটিট খ্রিস্টধর্ম থেকে জরথুষ্ট্র ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । প্রাচীন ইরানীয় ধর্ম হল পার্সি বা জরথুস্ত্রবাদ । তারা সকল প্রকার ধর্মে অবিশ্বাসী। কয়েকশ বছর আগে ইরানে মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্যাতনের জন্য পার্সিরা ইরান থেকে ভারতে পালিয়ে আসে । তাদের মধ্যে ছিলেন স্যার দিনশ পেটিটের পূর্ব পুরুষরা । দিনশ পেটিট পরিবার নিয়ে বোম্বেতে থাকতেন । ভারতে আসার পর মহম্মদ আলি জিন্নাহের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে । দিনশ পেটিটের একমাত্র মেয়ে ছিলেন রতনবাই (রুটি) পেটিট । তখন জিন্নাহর বয়স ৪২ এবং রতনবাইয়ের ১৬ । কিশোরী রতনবাইয়ের অপরূপ রূপে মজেছিলেন জিন্নাহ ।
বন্ধুত্বের সুযোগে রুটি পেটিটকে তিনি প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ফেলেন । বয়সে ২৬ বছরের ছোট মেয়েটির সঙ্গে গড়ে তোলেন শারিরীক সম্পর্ক ৷ দিনশ পেটিট যখন এই সম্পর্কের কথা জানতে পারেন তখন তার আর করার কিছু নেই । মেয়ে তখন সম্পূর্ণ জিন্নাহের বশে চলে গেছে । বন্ধু মহম্মদ আলি জিন্নাহের এতবড় বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ভেঙে পড়েন । জিন্নাহ যখন তাকে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের কথা বলে তখন তিনি জিন্নাহকে বাড়ি থেকে বের করে দেন । শুধু ধর্ম আলাদা এই কারনে নয়, দুইজনের বয়সের পার্থক্য তার বাবা মানতেই পারেননি। একমাত্র মেয়েকে অনেক আদরে রেখেছিলেন তিনি। বছরখানেক পর নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রতনবাই ঘোষণা করেন যে তিনি জিন্নাহকেই বিয়ে করবেন। তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন ও জিন্নাহকে ইসলামি রীতিতে বিয়ে করেন।
কিন্তু রতনবাইয়ের জীবনে ইসলাম ছিল এই পর্যন্তই । শুধু ভালোবাসার আবেগে তিনি মুসলিম হলেও বাকি জীবন ইসলামিক রীতি অনুসরণ করেননি । পরবর্তী জীবন তিনি না পড়েছেন নামাজ, না মেনেছেন খাদ্যভাস । জিন্নাহও তাকে জোর করেনি কারন সে নিজেও খুব কম ইসলাম অনুসরণ করতেন । মদ্যপান থেকে শুরু করে মাংসের কোনো বাছবিচার করতেন না জিন্নাহ । জানা যায় রতনবাই এত খোলামেলা পোশাক পরতেন যে সেইসময়ের ব্রিটিশরাও অবাক হয়ে যেত । বিয়ের পর প্রায়ই ইউরোপে ছুটি কাটাতে যেতেন । কয়েকবছর পর তাদের একমাত্র মেয়ে দিনা ওয়াদিয়ার জন্ম হয়। দিনা বাবা মা-বাবার কারোর খুব বেশি সান্নিধ্য পাননি। বাবা রাজনীতিতে ব্যস্ত, মা ব্যস্ত পার্টিতে। রতনবাইকে বিয়ের পর জিন্নাহের পরিবার তাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে । যদিও বিয়ের কয়েকবছর পর রতনবাই ও জিন্নাহর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে কোলন ক্যান্সারে মাত্র ২৯ বছর বয়সেই মারা যান রতনবাই।
দিনাকে দেখাশোনা করতেন ফাতিমা জিন্নাহ, জিন্নাহর বোন। তবে দিনাও তার মায়ের পথ অনুসরণ করেন। তার মা রতনবাই যেমন তার বাবার কথা এড়িয়ে একজন মুসলিমকে বিয়ে করেন তেমনি তিনি তার বাবার পছন্দ এড়িয়ে নেভিল ওয়াদিয়া নামের একজন পার্সি খ্রিস্টানকে বিয়ে করেন । জিন্নাহ চেষ্টা করেন তার মেয়েকে থামাতে তবে ব্যর্থ হন ।
শোনা যায় এরপর জিন্নাহ তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেননি। তবে একটি সূত্র এইও বলে জিন্নাহ মেয়ের বিয়েতে গোপনে তার জন্য ফুলের তোড়া পাঠান ড্রাইভারকে দিয়ে। দিনার সাথে জিন্নাহর শেষ দেখা ১৯৪৬ সালে মুম্বাইয়ে। তার সাথে ছিলো তার ছেলে নেসলে ওয়াদিয়া। নিজের নাতিকে একটি হ্যাট উপহার দেন জিন্নাহ।
দেশভাগের পর জিন্নাহ পাকিস্তান চলে যান। দিনা ভারতে, পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে থাকতে শুরু করেন । পাকিস্তানে যান ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর তাকে দেখতে। যদিও পিসি ফাতিমার সাথে তার যোগাযোগ ছিলো ।জিন্নাহর নাতি নেসলে ওয়াদিয়ার হলেন একজন ভারতীয় ক্রিকেটার । আইপিএলে কিংস ইলেভেনের হয়ে এবারে খেলছেন তিনি । অভিনেত্রী প্রীতি জিনতার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড নেসলে ওয়াদিয়া ।
তবে জীবনযাপন যাই হোক না কেন,দিনা ওয়াদিয়া তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তার বাবার রাজনৈতিক স্বপ্ন পাকিস্তানকেও সমর্থন করেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে ইংল্যান্ড, আমেরিকায় থাকেন ও ২০১৭ সালে আমেরিকায় মারা যান। তার ছেলে ব্রিটিশ ভারতীয় নুসলি, নাতি নেস সবাই ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ী । দেশ ভাগের দীর্ঘ কয়েক দশক পর ২০০৪ সালে পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ভারত- পাকিস্তান ক্রিকেট সিরিজ চলাকালে ভারত থেকে ছেলে ও নাতি সহ দিনা পাকিস্তান গিয়েছিলেন । সেখানে তার বাবার কবর পরিদর্শন করেন। বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পরেন তিনি। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে তিনটি ছবি চান।
তবে ইতিহাস বড়ই নির্মম। ধর্মের ভিত্তিতে যে জিন্নাহ ভারতকে খণ্ডবিখণ্ড করেছিল, আজ তার পুরো পরিবার ব্রিটিশ ভারতীয় । কেউ পাকিস্তানি নয় । এমনকি তারা ইসলাম পর্যন্ত অনুসরণ করে না । ভারতের ইতিহাসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জহরলাল নেহেরু ও মহম্মদ আলি জিন্নাহরা কতবড় অভিশাপ ছিল, তার মূল্যায়ন একদিন ঠিক হবে ।।

