জন্ম এবং কর্ম উভয় সূত্রেই কলকাতা নিবাসী। গল্পের ছন্দে ভবঘুরে চরিত্র হলে মন্দ হতনা। এক্ষেত্রে পুরো উলটপুরান। যাকে বলে কুয়োর ব্যাঙ। খুব প্রয়োজন ছাড়া কলকাতার বাইরে এই ছাব্বিশটা বছরে গেছি বলে মনে পড়ে না। যাই হোক কর্মসূত্রে এবারের গন্তব্য হাজারিবাগ। ঝাড়খণ্ডের ছোটো একটি জায়গা, অনামী হলেও উপভোগ্য। সঠিক সময়ে পৌঁছালাম কলকাতা স্টেশন তাও আবার মা-বাবার হাত ধরে। খুব একটা একা বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার নেই বললেই চলে। বাড়ির একমাত্র কন্যা হওয়ার জন্য ছোটোবেলা থেকে মা-বাবার সাথে সখ্যতা একটু বেশীই ছিল আমার। আমায় না দেখে তাদের যেমন দিন কাটত না ঠিক তেমনই তাদের ছাড়া আমার আবার ঠিক চলতও না।
যাই হোক চেপে বসলাম জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে। যথা সময় ট্রেনও ছেড়ে দিল। কলকাতাকে বিদায় জানিয়ে পাড়ি দিলাম সুন্দর নতুন দেশে। নদী-নালা, সাত সাগর, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে ট্রেন নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে। সত্যিই “সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়”। সূর্য্যিমামা কখন যেন ঢলে পড়ল ওই নীল আকাশের কোলে, ধূসর থেকে কালো। নিকষ কালো অন্ধকার ঘিরে ধরল পৃথিবীটাকে।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এসে নামলাম হাজারিবাগ রোড। ছোট্ট স্টেশন। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। দূরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। ছোট্ট দোকানঘরে দোকানি চা-বিস্কুটের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। দেখলে মনে হবে ভৌতিক গল্পের আস্ত একটা প্লট। আশা ছিল ভৌতিক কোনো অভিজ্ঞতা হবে। যা হল তাও কম না। যাকে বলে এক্কেবারে রোমাঞ্চকর, রোমহর্ষক।
ট্রেন থেকে নেমে গেলাম স্টেশন মাস্টারের ঘরে। গুটি কয়েক লোক বসে আছে ঘরটিতে। স্টেশনের বিশ্রামালয়টি আগে থেকেই বুকিং ছিল আমার ও মায়ের নামে। নিয়ম অনুযায়ী তিনজনকে ওই ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়ার কথা নয়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই অচেনা লোক গুলোই হয়ে উঠল পরম আপন। এই এত রাতে একা কোথায় যাবেন?
মানিয়ে নিতে পারলে আমাদের কোনো অসুবিধা, নেই, শর্ত শুধু একটাই যে পরের দিন কোনো বুকিং থাকলে ঘরটি ছেড়ে দিতে হবে। নাহলে শুধু শুধু আপনাদের বিপদে ফেলার কোনো মনোভাব আমরা পোষণ করিনা – স্টেশন মাস্টার সবরকম সাহায্য আশ্বাস দিলেন। কলকাতা ফেরার ট্রেন গভীর রাতে শুনে উনি বললেন – কোনো অগ্রিম বুকিং না থাকলে আমরা ট্রেন আসা পর্যন্ত ওই ঘরে থাকতে পারি। আজকালকার এই দুর্নীতির বাজারে এরকম মানুষজন পাওয়া সত্যিই বিরল!
হাজারিবাগে আমার কর্মস্থল ছিল এই সরিয়া অঞ্চল থেকে মে ৬৩ কিমি দূরে টাউনে। এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল! আসলে হাওড়ায় বসে কোনো মানুষের পক্ষে এটা কি ভাবাই সম্ভব নয় যে হাজারিবাগ স্টেশনটা আসলে সরিয়া অঞ্চলে এবং সেটি টাউন থেকে প্রায় ২ ঘন্টার রাস্তা। ওখানকার এক অদ্ভুত নিয়ম হল সকাল ১০ টার পর টাউন যাওয়ার বাস কমে যায়। আবার বিকেল সাড়ে ৫ টার পর টাউন থেকে সরিয়া আসার বাস পাওয়া যায় না। এই খবর টাও স্টেশন মাস্টার আমাদের দিলেন, তাও ফোনে অন্যের থেকে জেনে। রাতে খাবার জায়গার সন্ধানও দিলেন।
ওনার কথামতোই আমরা স্টেশনের ফুটব্রিজ টপকে রওনা দিলাম বড় রাস্তার দিকে। গোটা রাস্তাটা জনমানবহীন, ফাঁকা ও অন্ধকার। কয়েকটি ছোটো দোকান আছে, তারাও ঝাঁপ বন্ধ করতে ব্যস্ত। কলকাতা শহর রাত জাগতে অভ্যস্ত হলেও এই অচিনপুরীতে রাত্রি গিলে খেতে আসে। সামনেই পেলাম নিউ হোটেল। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়লাম। বাঙালি খানা যেমন মিলল তেমনই আলাপ হল এক প্রবাসী বাঙালির সাথে। হোটেলটির মালিক আমাদের তিলোত্তমারই সন্তান, শ্যামবাজারে বাড়ি। স্বভাবতই এতদিন বাদে বাঙালি দেখে তিনি উত্তেজিত এবং একই সাথে অভিভূত।
তার কাছেই জানতে পারলাম এক সময় এই জায়গাটিতে ছিল প্রচুর বাঙালির বাস। মনোরম পরিবেশে ছুটি কাটাতে অনেক বাঙালি ছুটে আসত এখানে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য ভীরু বাঙালিদের মনে মিথ্যা ভয়ের সঞ্চার ঘটিয়ে তাদের এখান থেকে বিতাড়িত করেছে। সবটাই শুধু অসৎ উদ্দেশ্য এবং লোভ চরিতার্থের খাতিরে। সেই বাঙালি ভদ্রলোকটিও আমার কর্মস্থলের বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য দিলেন। অনেক গল্পের পর ফিরে এলাম স্টেশনের ঘরে। সাহেবি আমলের ঘর। বড়ো বড়ো দরজা, জানালা, কড়িকাঠ সবই আছে। রাত্রি যাপনের জন্য এটুকুই যথেষ্ট মধ্যবিত্ত ছাপোষা বাঙালির ক্ষেত্রে। এই হাজারিবাগ স্টেশনেই লণ্ঠনের ব্যবহার দেখলাম যেমনটা ঠিক চলচ্চিত্রে দেখে থাকি। সারারাত ট্রেনের কু ঝিক ঝিক এবং বাঁশির আওয়াজে ঘুম হল না। উচ্চ গতিবেগ সম্পন্ন কোনো ট্রেন গেলে ঘরটিতে ভূমিকম্পের ন্যায় কম্পন অনুভূত হচ্ছিল। পরের দিন সকালবেলা যথাসময়ে প্রস্তুত হয়ে রওনা দিলাম আমার নতুন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রেও সাহায্যের হাত যথারীতি বাড়িয়ে দিলেন সেই অবাঙালি ভদ্রলোক। এক্ষেত্রে বলে রাখি পূর্বরাতে রেলের একজন দোকানি আমায় আমার গন্তব্যস্থল সম্বন্ধে সম্যক ধারণা দিয়ে রেখেছিল। তাই মুহূর্ত দেরী না করে এসে পৌঁছালাম বড় রাস্তার মোড়ে। কিছুক্ষণ বাদেই উপস্থিত হল বাস। চেপে বসলাম তাতে। গভীর, সবুজ বনভূমির বুক চিরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলল বাস। উঁচু-নীচু উপত্যকা, আকাশি পথ, ঘন জঙ্গল- এ এক আলাদা অনুভূতি, এক আলাদা অভিজ্ঞতা। এরকম জীবনই তো দরকার বেঁচে থাকার জন্য। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে এসে পৌঁছালাম গন্তব্যস্থলে।
সারাদিন কাজের পরে এবার বাসায় ফেরার পালা, তা সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কোনোক্রমে শেষ বাসটি পেলাম। শেষ রক্ষে হলো। না হলে এই অজানা ঠিকানায় এসে বিপদে পড়তাম। বাসের গতি সকালের চেয়েও বেশী। চারিদিকে নিঝুম, নিশুতি রাতের কালো চাদরে ঢাকা পড়েছে বনানী। সত্যিই রাতের জঙ্গল অনেক বেশী গম্ভীর, নিশ্চুপ, ভয়ংকর। অমাবস্যার আঁধারে প্রকৃতিও আজ যেন ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন। এসে নামলাম বাঘাচকে।
স্টেশন থেকে মিনিট দশেকের দূরত্ব। অন্ধকার ঠেলে এগিয়ে চললাম স্টেশনের দিকে, নিঝুম রাতে তারার সাথে। প্রকৃতির সাথে সখ্যতা তো আমার বহু দিনেরই । হোটেলে নৈশভোজ সেরে সেই বাঙালি বন্ধুটিকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম চেনা ঘরটাতে। রাত ১১ টার দুন এক্সপ্রেসে টিকিট কাটা। স্টেশনে এসে শুনলাম ৫ ঘন্টা দেরীতে ছুটছে গাড়ি। অতএব অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হলো। সুদীর্ঘ ঐ রজনী যেন কাটে না। দূরে যেন কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমায় বলছে- খেলবি আমার সাথে? মিশবি আমার রঙে? এ যে অমোঘ আকর্ষণ, এড়ানো যে দায়। বিলীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ধূসর প্রান্তরে। হঠাৎই ঘণ্টাধ্বনি। ওই দেখা যায় সুদূরে আলোর রেখা। প্রতীক্ষার অবসান। ভোর ৪ টা নাগাদ ট্রেন এসে পৌঁছাল হাজারিবাগ স্টেশনে। উঠে পড়লাম ট্রেনে।
সজলচক্ষে বিদায় জানালাম দুইদিনের এই আপন হয়ে যাওয়া বন্ধুটিকে। বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে কোনো একদিন ওই পাহাড়ের কোলে, ওই বনানীর মাঝে। গগনভেদী হুঙ্কার তুলে এগিয়ে চলল রেলগাড়ী। পিছন ফিরে দেখলাম রিক্ত হাতে, সিক্ত নয়নে, অনেক হতাশা-যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে হাজারিবাগ। তার বিদীর্ণ বক্ষের সেই আর্তনাদ, যন্ত্রণা মাখা চোখের চাহনিতে শুধু একটাই প্রশ্ন :- ‘আবার আসিবে কবে
ফিরি দেখা খুব নীরবে
তোমার অপেক্ষায়
দাঁড়িয়ে আছি একাকী আমি
না হয় হলাম এক অনামী
ফিরবে না কি হায় ।’।