অফিসের কাজে চল্লিশ দিন হল সুব্রত দিল্লিতে । লক ডাউনে আটকে পড়েছে । এল. আই. সি. অফিসের গেস্ট হাউস এখন ওর বর্তমান ঠিকানা । সারা দিন ধরে একা একা আর ভালো লাগছে না । বুকান ও অনন্যার সঙ্গে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হচ্ছে । অনন্যা বলছিল ক’দিন ধরে বুকানের শরীর টা ভালো নেই । ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে ঠাকুমা ঠাকুমা করে জেগে উঠছে । বাড়িতে অনন্যা একা আজ। যদি মা থাকতো তাহলে সুব্রতর এতো চিন্তা হতো না । মা’র জন্যে সুব্রত অস্থির হয়ে উঠল ।
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে অশান্তি এমন চরম আকার ধারণ করতে পারে তা সুব্রত আঁচ করতে পারে নি। অথচ মা নিজে দায়িত্বে তার পিসির মেয়ের শশুর বাড়ির কোনো এক আত্মীয়র এক মাত্র মেয়ে কে বউ মা করে নিয়ে এসে ছিল ।
প্রথম দিকে সব কিছু ঠিক ঠাক ছিল বুকান হওয়ার কিছু দিন যেতে না যেতেই অশান্তি শুরু । বহু চেষ্টা করেও সুব্রত এ ই সমস্যার সমাধান করতে না পেরে এক দিন মা ও অনন্যা কে এক সঙ্গে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল তোমরা কি চাও বল ? আমি কি তাহলে সুইসাইড করবো । এ কথা বলতেই মা বলে উঠলো আ ! খোকা আমার জন্যে তোকে মরতে হবে কেন ? এ সব কথা আর কখনও মুখে আনবি না । তোর বউ যা চায় তাই হবে । পরিশেষে সহধর্মিনীর আদেশ অনুসারে মা আজ দু বছর বৃদ্ধাশ্রমে ।
দ্বিতীয় দফার লক ডাউনের শেষ । কোম্পানি থেকে বাড়ি ফেরার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করেছে । সুব্রত ছাড়া আর ও তিন জন এখানে আছে । ওদের সবাইকে নিয়ে আজ বিকেলে গাড়ি রওনা দেবে । খবরটা অনন্যা শুনে খুবই আনন্দিত হল । মা কে তিন চার বার ফোন করে ও পেল না। সুব্রতর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ।
সারা রাস্তা সারা রাত শুধু মা এর কথা মনে পড়ছে সুব্রতর ।
ছোট বেলায় বাবা মারা যাবার পর মা একা হাতে আমাদের দুই ভাই বোন কে মানুষ করেছে । আশাকর্মীর সামান্য বেতন তাতে সংসার চালানো খুবই কঠিন । তাই মা রাত জেগে সেলাই করেছে । তবু কোন দিন আমাদের কোনো কষ্ট করতে দেয়নি । ভাবতে ভাবতে সুব্রতর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । ভোরের আলো ফোটার আগেই ওদের গাড়ি চন্দননগর এসে হাজির । এরই মধ্যে বাকি তিন জন সহকর্মী নিজ নিজ বাড়িতে নেমে গেছে । ড্রাইভার সুব্রত কে জিজ্ঞাসা করে সাহেব আপনি কোথায় নামবেন ? চন্দননগর তো এসে গেছে । সুব্রত জানলার কাচ নামিয়ে দেখে চন্দননগর গভর্নমেন্ট কলেজে সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ।
সুব্রত গাড়ি থেকে নেমে গঙ্গার দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । কলেজের বাঁ দিকের গলি দিয়ে এক টু গেলেই তার বাড়ি, কিন্তু সুব্রত র বাড়ি ফেরার ইচ্ছে টা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । সুব্রত ড্রাইভার কে বলে আর একটু যেতে হবে ওই মাইল পাঁচ হবে চলুন ।
গঙ্গার পাস দিয়ে সাদা রঙের টাটা সুমো তীব্র গতি তে এগিয়ে চলেছে । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠবে বোধ হয় । সুব্রতর বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল । দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমের গেট, বড় বড় করে লেখা আছে “বিকেলের ফুল” । সুব্রত ড্রাইভার কে বলে আমাকে এখানে নামিয়ে দিন । গাড়ি থেকে নেমে সুব্রত প্রথমে হাঁটতে শুরু করল, তার পর ছুট তে শুরু করে হাতে আর সময় নেই বড্ড দেরি হয়ে গেছে….