প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়,বর্ধমান,৩০ এপ্রিল : ’মমতা দিদি যত সন্ত্রাস করার আছে করে নিন। আপনার আর আপনার ভাইপোর বিদায় সুনিশ্চিত হয়ে গেছে। আপনাকে চলে যেতেই হবে’।লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মঙ্গলবার পূর্ব বর্ধমানে এসে কার্যত এই ভাষাতেই তৃণমূল সরকারের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একই সঙ্গে তিনি বলেন,“সারা দেশে উন্নতি হচ্ছে, শুধু বাংলায় পিছিয়ে যাচ্ছে। আমরাই বাংলাকে দেশের এক নম্বর রাজ্য বানাবো। সফল হবে সোনার বাংলার কল্পনা“।এর জন্য অমিত শাহজি ফের আর একবার এবারের লোকসভা ভোটে বাংলা থেকে ৩০ আসন জয়ের টার্গেট বেঁধে দেন।
বর্ধমান পূর্ব লোকসভা আসনে এবার পদ্ম ফোটাতে মরিয়া বিজেপি শিবির। হরিণঘাটার বিজেপি বিধায়ক তথা কবিয়াল অসীম সরকারকে এবার এই আসনের প্রার্থী করেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। তারই সমর্থনে এদিন পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া এবং মেমারি রসুলপুরে নির্বাচনের জনসভা করেন অমিত শাহ। সভায় বক্তব্য রাখতে উঠে অমিত শাহ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার ভাইপো তথা তৃণমূলের সেকেন্ড ইন-কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেন ।লোকসভা ভোটের সময়েও বাংলায় চলা হিংসা সন্ত্রাস এবং সন্দেশখালি প্রসঙ্গ সামনে এনে অমিত শাহজি এদিন তৃণমূল কংগ্রেসকে কার্যত তুলে ধরা করেন।
অমিত শাহ তার ভাষণে বলেন,’এবারের লোকসভার ভোট হলো,বাংলার জনগণ পরিবার বাদ চান, নাকি রাম রাজত্ব চান, সেটা ঠিক করার ভোট।“ জনসভায় উপস্থিত মানুষজনের কাছে শাহজি প্রশ্ন রাখেন,”আপনারা কি ভাইপোকে সিএম বানাতে চান, নাকি মোদীজি কে পিএম বানাতে চান? মোদীজি কে পিএম বানাতে চাইলে, অসীম সরকারকে ভোটে জিতিয়ে সাংসদ বানান। আর বাংলা থেকে বিজেপিকে ৩০ আসন দিন।’ এর সাথে সাথে তিনি ভাইপোর রাজত্ব এবার শেষ হবার ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন ।
অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ এবং সেই মন্দিরে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হওয়াটাও যে কেন্দ্রের মোদী সরকারের সাফল্য তা জনসভায় তুলে ধরতে ভোলেন নি অমিত শাহজি । এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিএম মিলে রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে শুধুই বিরোধিতা করে গেছে। আগের লোকসভা ভোটে আপনারা বাংলা থেকে ১৮ টা সিট দিয়ে মোদিজি কে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী করেন। মোদিজি পাঁচ বছরেই রাম মন্দির সংক্রান্ত মামলা যেতেন,ভূমি পুজোও হয়। রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। রাম মন্দির তৈরি হয়ে যাওয়ার পর রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে মমতা দিদি এবং তার ভাইপোকে নিমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীদের ভয়ে তারা কেউই সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন নি বলে অমিত শাহ জানান ।
কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রসঙ্গ সামনে এনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন,“ কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ হোক এটা মমতা দিদি চাননি। এ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে কটাক্ষ করে অমিত শাহ বলেন,“মমতা দিদি, আপনার কথায় দেশ চলে না। বাংলার জনগণ চায়,ভারতের ঝান্ডা কাশ্মীরে আকাশ ছুঁয়ে থাকুক। তাই মোদীজি ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ধারা ৩৭০ এর সমাপ্তি ঘটিয়ে কাশ্মীরকে চিরদিনের জন্য ভারতের বানিয়ে দিয়েছেন।
বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগ এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটি জনসভা থেকেই সরব হচ্ছেন। এই অভিযোগ কে নস্যাৎ করতে কাটোয়া এবং মেমারির জনসভা থেকে অমিত শাহ এদিন বাংলাকে দেওয়া কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্যের খতিয়ান তুলে ধরে ন। তিনি জানান,“বাংলার গরিবদের কল্যাণে ১০ বছর মোদীজি কাজ করেছেন। বাংলার কোটি কোটি গরীব বিনামূল্যে যে চাল পায়, সেটা প্রধানমন্ত্রী মোদিজি পাঠান। ১২ কোটি লোকের ঘরে শৌচালয় বানানোর কাজ মোদি সরকার করেছে। চার কোটি গরিব লোককে ঘর দেওয়া, ১০ কোটি লোককে গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়া এবং ১৪ কোটি লোকের ঘরে নল বাহিত জল পৌঁছে দেয়ার কাজ মোদি সরকারই করেছে ।’ কিন্তু মোদির যোজনাকে দিদি তলা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চান না। এবারের লোকসভা ভোটে, বাংলা থেকে ৩০ এর বেশি সিট মোদির ঝুলিতে দিন, ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ফ্রিতে করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে অমিত শাহ জনসভায় উপস্থিত মানুষজনকে আশ্বস্ত করেন।
তৃণমূল কংগ্রেস দল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিশানা করে অমিত শাহ বলেন,দিদি এবং উনার ভাইপো অভিষেক দুজনেই বিজেপির ভয়ে আছে। তাই আমাদের নেতাদের হোটেল বুক হতে দেয় না। গাড়ি মেলেনা। যে হোটেল বুক হয় সেটা মমতার গুন্ডারা খালি করে দেয়। এরপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে উদ্দেশ্য করে অমিত শাহ বলেন,“ মমতা দিদি, যত সন্ত্রাস করার আছে করে নিন। আপনার আর আপনার ভাইপোর বিদায় সুনিশ্চিত। আপনাদের চলে যেতেই হবে ।’ ২০২১ শের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির কার্যকর্তাদের খুন হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ সামনে এনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ভারতীয় জনতা পার্টির কার্যকর্তাদের দিদির গুন্ডারা মেরেছে। এই কথা জানিয়েই শাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন,“দিদি আপনাকে বলে যাচ্ছি,যারা যারা এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে তাদেরকে বাংলায় বিজেপি সরকার ঘটনার পর পাতাল থেকে খুঁজে বের করে এনে জেলে পাঠাবো“। একই সঙ্গে অমিত শাহ বলেন,“এই রাজ্যে বিজেপি কার্যকর্তাদের গাঁজা ও চরসের কেস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আদালত নির্দোষ বলে দিচ্ছে। মমতা দিদি আপনার লজ্জা হওয়া উচিত, নির্দোষ কার্যকর তাদের আপনি নারকটিক কেস দিচ্ছেন!”
কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের নাম বদল নিয়ে কাটোয়া এবং মেমারি জনসভা থেকে সরব হন অমিত শাহ। তিনি বলেন,’মোদীর সমস্ত যোজনায় মমতা দিদি নিজের নাম লাগিয়ে দেয়। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন,পিএম ফসল বীমা যোজনা বাংলা ফসল বীমা যোজনা করে দিয়েছে। পিএম আবাস যোজনা বাংলা আবাস যোজনা করে দিয়েছে। কেন্দ্রের স্বচ্ছ ভারত অভিযান মিশন নির্মল বাংলা করে দিয়েছে। পিএম গরিব কল্যাণ যোজনা কে খাদ্য সাথী এবং জল জীবন মিশনকে জল স্বপ্ন পরিযোজনা করে দিয়েছে। এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মোদিজি বাংলাকে ১০ লক্ষ কোটি টাকা দিয়েছে।’ কিন্তু তৃণমূলের গুন্ডারা মোদিজীর দেওয়া দশ লক্ষ কোটি টাকা খেয়ে নিয়েছে বলে অমিত শাহ অভিযোগ করেন।
সন্দেশখালীর প্রসঙ্গ তুলে ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সন্দেশখালীর মত ঘটনা দুনিয়ার কোথাও দেখা যায়নি । মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বে হাজার হাজার মহিলাকে শোষণের কাজ টিএমসি নেতারা করেছে। যারা সন্দেশখালিতে মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করেছে তাদের জেলে পাঠানোর কাজ বিজেপি করবে ।’
বাংলায় সিএএ লাগু হবেই বলে আমিত শাহ এদিন স্পষ্ট করে দেন। তিনি বলেন,’ওইদিন আর বেশি দূরে নেই। বাংলায় বিজেপি সরকার গঠিত হবে। মমতা দিদি সিএএ এর বিরোধিতা করছেন। ভোট ব্যাংকের জন্য অনুপ্রবেশ রুখছেন না।আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি,বাংলায় সিএএ হবেই ।’ মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে অমিত শাহ বলেন,’মমতা দিদি, বাংলাদেশের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব মিললে আপনার কি অসুবিধা?অনুপ্রবেশকারী ভোটাররা নারাজ হবে?’ অমিত শাহ পরিষ্কার জানিয়ে দেন, প্রত্যেক শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ মোদি সরকার করবেই। মমতা দিদি আপনি আটকাতে পারবেন না।।