এইদিন ওয়েবডেস্ক,পূর্ব বর্ধমান,২৪ এপ্রিল : ২০১৬ সালে এসএসসির প্যানেলে নিয়োগ হওয়া নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ, গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল করেছে কলকাতা হাইকোর্টে । লোকসভা ভোটের মুখেই চরম বিপাকে পড়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস । ‘বিজেপি-আদালত ষড়যন্ত্র’ এবং ২৬ হাজার ‘চাকরি খেয়ে নেওয়া’র তত্ত্বকে হাতিয়ার করে তৃণমূল প্রচারের ময়দানে ঝাঁপালেও নিয়োগ দূর্নীতিতে বিপাকে পরা তৃণমূল সুপ্রীমো আজ বুধবার পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের নির্বাচনী জনসভায় জানান যে একসঙ্গে অতগুলো চাকরি বাতিল না করে আদালত ‘স্কুটিনি করতে’ এবং রাজ্যকে ‘পরামর্শ দিতে’ পারত । মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর অনেকে অনুমান করছে যে নিয়োগ দূর্নীতি কান্ডে আদালতের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি ।
বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী অসিত মালের সমর্থনে আজ দুপুরে আউশগ্রামে নির্বাচনী জনসভা করেন মমতা ব্যানার্জি । কলকাতা হাইকোর্টের দুই সদস্যের বিচারপতি বেঞ্চের প্রায় ২৬ হাজার চাকরি বাতিল করা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমিও আইনের ছাত্রী ছিলাম । এখনও আমি বার কাউন্সিলের সদস্য আছি । আমি যেকোনো দিন কোর্টে ল’ইয়ারগিরি করতে পারি । আমি বিচারকদের নিয়ে কথা বলবো না, কিন্তু জাজমেন্ট নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার আছে । আমি মানি না । যদি কেউ অন্যায় করে থাকে তুমি স্কুটিনি করতে পারতে। তুমি পরামর্শ দিতে । তা না করে একসঙ্গে ২৬ হাজার ছেলে মেয়ের চাকরি খেয়ে নেওয়া, এটা মজা নাকি ? এটা কি মগের মুলক?’
মুখ্যমন্ত্রী কলকাতা হাইকোর্টকে বিজেপির একটা মহা ‘তীর্থক্ষেত্র কেন্দ্র’ বলে কটাক্ষ করেছেন । তিনি বলেন, ‘বিজেপি পিল(PIL)করলেই যা বলবে একেবারে তাই হবে । আর অন্য কেউ যদি বিচার চায় তাদের জন্য দরজা বন্ধ । কোন বিচার পাবেন না । বিজেপির কথায় ডাকাতদের বেল দিচ্ছে, মাফিয়া দের বেল দিচ্ছে, আর সবচেয়ে বড় গাদ্দারের বিরুদ্ধে খুনের কেস থাকা হত তাকে বলছে গ্রেপ্তার করা যাবে না । এটাই কি আইন?’
নিয়োগ দূর্নীতি কান্ডে মুখ্যমন্ত্রীর সাফাই, ‘মুখ্যমন্ত্রী বলেন এই রাজ্যে কোন ডিপার্টমেন্ট কাকে চাকরি দেয় আমি অত দেখি না । কিন্তু খারাপ লেগেছে ২৬ হাজার জনকে সরিয়ে দেওয়ার পর । আবার বলছে এক মাসের মধ্যে ১২ শতাংশ সুদ দিয়ে সব টাকা ফেরত দিতে হবে । যদি বিজেপির নেতাদের বলি এই সমস্ত কেস করে শিক্ষিকা শিক্ষকদের চাকরি খাচ্ছ, সরকারি কর্মচারী বেকার ছাত্র যুবকের চাকরি খাচ্ছ, তাহলে এই ২৬ হাজার ছেলেমেয়ে যাবে কোথায়? বাংলায় কি সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে?’ তিনি দাবি করেন,’আমার হাতে এখনো ১০ লক্ষ চাকরি আছে কিন্তু আদালতে গেলেই আটকে দিচ্ছে ।’
নাম না করে এদিন ফের বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিশানা করেন মমতা ব্যানার্জি । তিনি শুভেন্দুর উদ্দেশ্যে বলেন,’কেষ্ট যদি দুর্নীতি করে অ্যারেস্ট হয়ে থাকে তাহলে তোমাদের গদ্দার তো সব থেকে বেশি দুর্নীতিবাজ । সে কেন অ্যারেস্ট হবে না? যারা মানুষ খুন করে অন্যদের সম্পর্কে বড় বড় কথা বলে । বোমা ফাটাবে? কি বোমা? না,২৬,০০০ লোকের চাকরি খেয়ে ড্রাম বাজাচ্ছে । খুশিতে গদগদো! ওরে মানুষের জীবনটা খুব ছোট, আমরা আজ আছি কাল নেই । যতক্ষণ থাকবো ভালো কাজ করে রাখবো, এটা মাথায় রাখবি । তোরাই তো দিল্লিকে বলেছিলি বাংলাকে ১০০ দিনের কাজে টাকা দেবে না। বাংলা আবাস দেবে না, রাস্তাঘাটে টাকা দেবে না, রেশনের টাকা দেবে না, জলস্বপ্ন সেটার ও ৭৫ শতাংশ টাকা আমরা দিই ।’
গরু পাচার মামলার জেলবন্দি বীরভূমের দলীয় নেতা অনুব্রত মণ্ডলের প্রশংসা করে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, কেষ্টকে আপনারা কত ভালবাসতেন, মাটির ছেলে । ওর অগুণ কি আছে আমি জানিনা । সেটা আইন আনাইনের পথে চলবে । কিন্তু একটা গরীব লোক যদি ওর কাছে দাঁড়াতো ও কিন্তু কাউকে কোনদিন ফিরিয়ে দিত না । আর জেলাটা ছিল ওর হাতের মুঠোয় । প্রতিটা নির্বাচনে ওকে নজরবন্দী করে রেখে দিত । যাতে ও ইলেকশনের দিন বেরোতে না পারে ।’ তিনি বলেন,’চাঁদুর বাড়ি তো রেড করলো । যেকোনো কারোর বাড়িতে রেড করতে পারে । রেড করে বলছে হয় বিজেপিকে ভোট দাও নয় ইডিতে, সিবিআইয়ে,ইনকাম ট্যাক্সে যাও । এই সরকারকে আপনারা রাখতে চান?’
মমতা ব্যানার্জি দাবি করেন বিনামূল্যে রেশন কেন্দ্র নয়,রাজ্য সরকার দেয় । মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘বিনা পয়সায় রেশন এখন কে দেয়, আমরা দি । বিজ্ঞাপন দিয়ে মিথ্যে কথা বলছে প্রচারবাবু । আমি আপনাদের তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলছি। আমরা প্রায় ৯ কোটি লোককে বিনা পয়সায় রেশন দি । প্রভিডে সময় একবার দিয়েছিল ছয় মাস এক বছর বন্ধ করে দিয়েছিল । ওদের রেশন এক চতুর্থ অংশ লোকও পায় না । আমাদের দিতে হয় বছরে ৯,০০০ কোটি টাকা । আর আমাদের টাকায় ওদের দিতে হতো সাত হাজার কোটি টাকা । তার মানে বছরের লাগে ১৬০০০ কোটি টাকা । ১২ হাজার কোটি টাকা তো দেয়নি । আমরা দু বছরে ৩০০০০ কোটি টাকার বিনা মূল্যে রেশন দিয়েছি । দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ওরা কিছু বলছে না । সারা পৃথিবী ওদের ছি ছি করছে ।’
১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে কেন্দ্র বকেয়া টাকা না দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,’যারা গরীব লোকেদের ১০০ দিনের কাজের টাকা দেয়নি, তিন বছর ধরে, আমাদের এখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে যায়, একটাই ট্যাক্স এখন দেশে, আমাদের ট্যাক্স নিয়ে যায়, কিন্তু সেই টাকা থেকে ১০০ দিনের মজুরি দেওয়া কথা ছিল, দেয়নি । তিন বছর টাকা দেয়নি । সাড়ে ৩০০ কমিশন এসেছে, কাগজপত্র দিয়ে আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি । তৃণমূলকে চোর বলার আগে, ওরে ডাকাতরা, একবার মুখ ফুটে বল তোদের রিপোর্টে কি আছে । মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের রিপোর্ট বের কর আর বাংলা রিপোর্ট বের কর ।’
প্রায় তিন মাস ধরে লোকসভার ভোট প্রক্রিয়া চলায় নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করে মমতা ব্যানার্জি বলেন,’বিজেপিকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইলেকশন কমিশন তিন মাস ধরে মানুষকে কষ্ট দিয়ে ইলেকশন করছে । অন্যান্য বারে দেখতাম যে ৭-৮ মে এর মধ্যে নির্বাচন হয়ে যেত । এবারে এমন কি হলো যে? জুন মাস পর্যন্ত নির্বাচন করতে হচ্ছে?’
মমতা ব্যানার্জির অভিযোগ বিজেপি জনগণের জন্য কিছু করেনি। ওরা জনগনের সব টাকা লুট করেছে। মিথ্যা কথা বলে আর ভাঁওতা দিয়ে জনগণের পকেট মেরেছে । আর সেই টাকা দিয়ে নিজের প্রচার করছে কিন্তু গরিব মানুষকে বাড়ি দিচ্ছে না। ১০০ দিনের কাজ দিচ্ছে না । সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে । চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নাই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে । ভাত দেয়ার ক্ষমতা নাই কিল মারার গোঁসাই ।
এদিনও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ছিল এনআরসি ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গ । এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আজ বলছে এনআরসি করব । সিএএ করব । ইউনিফর্ম সিভিল কোড করব । মানে আপনার ধর্ম বিক্রি হয়ে যাবে। আপনার অধিকার বিক্রি হয়ে যাবে। আপনার সম্পত্তি কেড়ে নেবে । আপনাকে না খাইয়ে মারবে । আপনাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দেবে । আমরা থাকতে এই জিনিস আমরা করতে দেব না ।
তাই সারাদেশে যে যেখানে আছেন, জোজি ধর মে হো বিজেপি কো খিলাপ ভোট দো । ফির বিজেপি আয়েগা তো দেসকো বেচ দে গা । দেশ নেহি রহেগা । দেশ কা ইতিহাস নেহি রহেগা । দেশ কা পরম্পরা নেহি রাহেগা । দেশকা ইউনিটি নেহি রহেগা । দেশকা মা-বোনকা সম্মান নেহি রাহেগা । ও ঝুটাবাদ করতে হ্যায় । বিজেপি একটা জুমলা পার্টি, একটা ভাঁওতাবাজ পার্টি, একটা মিথ্যাবাদী পার্টি । যত চোর,ডাকাত, মাফিয়া বিজেপিতে নাম লিখিয়েছে । যারা তৃণমূল করে তাদের বুকের পাটা আছে । তারা লড়াই করে বেঁচে আছে । আমাদেরও রোজ দশটা করে চিঠি পাঠায় । কখনো ইডি পাঠাচ্ছে, কখনো ইনকাম ট্যাক্স, কখনো সিবিআই পাঠাচ্ছে । ওদের চোর ডাকাতদের একটাও চিঠি পাঠিয়েছে?’
রাজ্যের উন্নয়নের ফিরিস্তি ও বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি । তিনি বলেছেন,’দেউচা পাঁচামিতে আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছি,কারণ ১০০ বছর পর্যন্ত যাতে বাংলার বিদ্যুতের অভাব না হয় ৷ বাংলা সারাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে৷ বাংলাকে কারো কাছে হাত পাততে হবে না৷ ১ লক্ষ ছেলে মেয়ের চাকরি হবে । বর্ধমান থেকে কোচবিহার পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর হচ্ছে । দুপাশ দিয়ে শিল্প গড়ে উঠছে । ডানকুনি থেকে পানাগর হয়ে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর হবে ।’
পশ্চিমবঙ্গে জোটের তত্ত্ব খারিজ করে মমতা ব্যানার্জি এদিন বলেন,’বাংলায় বিজেপির দুটো চোখ, একটা কংগ্রেস আর একটা সিপিএম। এই দুটোকে দাঁড় করায় কেন জানেন? যদি কিছু ভোট কাটা যায় টাকা দিয়ে । তখন তৃণমূলের থেকে কিছু ভোট চলে যাবে, যদি তারা জিততে পারে।’ তিনি আরও বলেন,’বিজেপিকে হারাতে হবে, তাই আমি এত রৌদ্রে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি । এক একটা সিট আমাদের চোখের মনির মত রক্ষা করতে হবে।’।