কিং কৰ্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ।
তৎ তে কৰ্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্ঞতত্ত্ব মোক্ষ্যসেশুভঃ ।। (শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যায় ৪, শ্লোক ১৬)
ভগবান বলেছেন : অর্থাৎ কি কর্ম, কি অকর্ম এ বিষয়ে বিবেকীগণও মোহিত হন; অতএব যা জানলে তুমি অশুভ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়কর্মে আসক্তি থেকে মুক্ত হবে সে কর্ম তোমাকে বলব।
এই জগৎ কর্মের ওপর নির্ভরশীল। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী থেকে শুরু করে একটি ধূলিকণা পর্যন্ত সবাই কর্মে রত। প্রতিটি জীবও সদা কর্মে রত। কর্মহীন অবস্থায় এ জগৎ থাকে না, তখন অব্যক্তে লীন হয়ে যায়। আবার কর্মের আরম্ভে জগৎ সৃষ্টি হয়। তাই ভগবান্ বলেছেন ক্ষণকালের জন্মও যদি তিনি কর্ম ত্যাগ করেন তবে কিছুই থাকবে না। ‘নিশ্চলং ব্রহ্ম উচ্চতে’ অর্থাৎ নিশ্চল অবস্থাই ব্রহ্ম। অনিচ্ছার ইচ্ছায় সেই অব্যক্ত ব্রহ্ম স্পন্দিত হলেই ব্যক্তাবস্থা, এই ব্যক্তাবস্থায় জগৎ সৃষ্টি। অতএব কর্মই জগতের নিয়ম। তাহলে সেটা কোন কর্ম? অতএব প্রথমে প্রকৃত কর্ম কি এবং অকর্ম’ই বা কাকে বলে তা জানতে হবে। এই কর্ম এবং অকর্মের বিভাগকে জেনে যা সঠিক কর্ম তা যদি করা যায় তাহলে মানব জীবনের যা পরম কাম্য সেই আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করা সম্ভব। অতএব প্রথমে অকর্ম কাকে বলে তা দেখা যাক। যে কর্মের দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকার হয় না তাই অকর্ম এবং যে কর্মের দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকার হয় তাই প্রকৃত কর্ম। জযোগিরাজ বলছেন-“প্রাণায়ামে ব্রহ্মজ্ঞান হয়”। অতএব যোগিরেেজর মতে প্রাণায়ামই একমাত্র কর্ম যার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। এটাই বিকম অর্থাৎ বিশেষরূপ কর্ম। সকল প্রকার কর্ম ত্যাগ করলেও শ্বাস প্রশ্বাসরূপ কর্ম জীবের পক্ষে ত্যাগ করা অসম্ভব। জীব শরীরে এই শ্বাসপ্রশ্বাসরূপ কম যতক্ষণ চালু আছে ততক্ষণ তাকে কর্মহীন বলা যায় না। কিন্তু অন্তর্মুখী প্রাণকর্ম করতে থাকন্সে যখন শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিরুদ্ধ অবস্থা লাভ হয় তখনই বেকাম অর্থাৎ প্রকৃত কর্মহীন অবস্থা আসে। কারণ যখন শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিও রুদ্ধ হয় তখন কোনোপ্রকার কর্ম। থাকা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় হৃদস্পন্দনও স্তব্ধ হয়ে যায়। যোগিরাজ এই প্রকার বেকাম অর্থাৎ কর্ম ত্যাগরূপ অবস্থায় পৌঁছে বলছেন যে এই অবস্থায় থাকাই এখন তাঁর একমাত্র কাজ অর্থাৎ কিছু করা এবং না করা উভয়হীন অবস্থায় থাকাই এখন তাঁর একমাত্র কাজ। এই অবস্থাকেই ক্রিয়ার পরাবস্থা বা কর্মের অতীতাবস্থা বলে। এই প্রকার কর্মহীন অবস্থায় পৌঁছে যোগিরাজ আরো বলছেন যে এই অবস্থা এক বড় আশ্চর্য্যরকম অবস্থা, যে অবস্থায় সব সময় থাকা প্রয়োজন অর্থাৎ প্রাণকর্মরূপ কর্ম করে সকল প্রকার কর্মের অতীতে পৌঁছে অর্থাৎ-কর্ম ত্যাগ রূপ অবস্থায় পৌঁছে যে নিশ্চল অবস্থা সেই অবস্থায় সর্বদা থাকতে হবে। সাধারণ মানুষ এই প্রকার ক্রিয়ার পরাবস্থা বা কর্মের অতীতাবস্থা অর্থাৎ নিশ্চল অবস্থা কি তা জানে না, তাই এই প্রকার স্থিরাবস্থা তাদের নিকট অকর্ম; কিন্তু যোগীর কাছে এই অবস্থায় থাকাই প্রকৃত কর্ম। অতএব সাধারণ মানুষ জাগতিক যে সকল কর্মকে কর্ম মনে করে যোগিগণ তাকেই অকম মনে করেন এবং সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার দরুন যাকে অকম মনে করে সেই স্থিরাবস্থায় থাকাকেই যোগিগণ কর্ম মনে করেন। এই বিষয়ে শ্রীভগবান্ বলেছেন-
কর্মণ্যকৰ্ম্ম যঃ পশ্যেদকৰ্ম্মণি চ কৰ্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেযু স যুক্তঃ কৃৎস্নকৰ্ম্মকৃৎ।।
(শ্রীমদভগবদগীতা অধ্যায় ৪, শ্লোক ১৮)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৪.১৮ : যারা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে কর্ম এবং কর্মের মধ্যে অকর্ম দেখেন, তারাই মানুষের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানী। সকল প্রকার কর্ম সম্পাদন করলেও, তারা যোগী এবং তাদের সকল কর্মের কর্তা।
অর্থাৎ যিনি কর্মের মধ্যে অকর্ম এবং অকর্মের মধ্যে কর্ম দেখেন, জনগণের মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান্ এবং সকল প্রকার কর্মকারী হয়েও তিনি ব্রহ্মে সংলগ্ন থাকেন। কর্মের মধ্যে অকর্ম অর্থাৎ ফলাকাঙ্খাযুক্ত যত প্রকার জাগতিক কর্ম, যার দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকার সম্ভব নয় । সেই সমস্ত কর্মকে যিনি অকর্ম বলে দেখেন এবং ফলাকাঙ্খারহিত নিষ্কাম যে প্রাণকর্ম, যা বাহ্যদৃষ্টিতে সাধারণের নিকট অকর্ম বলে মনে হয় অর্থাৎ যে কর্মের মাধ্যমে কর্ম ত্যাগরূপ অবস্থায় নিশ্চল ব্রহ্মে অবস্থান করা যায়, সেই অকর্মরূণ নিষ্কাম প্রাণকর্মকে যিনি কর্ম বলে দেখেন অর্থাৎ প্রাণকর্ম’ই একমাত্র কর্ম এবং অপর সবই অকর্ম এই প্রকার যিনি জানেন তিনি মনুষ্যগণের মধ্যে বুদ্ধিমান।
এই প্রকার বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি জাগতিক সকল প্রকার কর্ম করেও ওই নিষ্কাম প্রাণ-কর্মের অতীতাবস্থায় স্থির ব্রহ্মে সদাযুক্ত হয়ে থাকেন এবং তখন তিনি অনাসক্তভাবে সকল কর্ম করে থাকেন। তাহলে কর্ম ত্যাগরূপ অবস্থা কখন লাভ হয়? অন্তর্মুখী প্রাণায়াম করতে করতে যখন নাসা পথে প্রাণের আগম- নিগমরূপ কর্মের স্থিত অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যখন কর্মের অতীতাবস্থায় প্রাণের স্থিতি হয় তখনই প্রকৃত কর্মত্যাগরূপ অবস্থা হয়।
★ যোগীরাজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা “শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগ ও অদ্বৈতবাদ” পুস্তক থেকে নেওয়া ।