ভারতে সরকারি কর্মচারীদের স্মৃতিকথা লেখার ঘটনা বিরল। আংশিকভাবে, এর কারণ হল সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের নজর থেকে দূরে পর্দার আড়ালে কাজ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) প্রাক্তন গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডি আত্মজীবনীমূলক একটা বই লিখেছিলেন । যার নাম অ্যাডভাইস এন্ড ডিসেন্ট (ADVISE AND DECENT)।২০০৩ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াইভি রেড্ডি । তার আগে ১৯৯১ সালে অর্থ মন্ত্রকের যুগ্ম সচিবে দায়িত্ব পালন করেছিলে তিনি । ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করা ওয়াই ভি রেড্ডির গোটা কর্মজীবন ছিল কংগ্রেসের জমানায় । তাই রাজীব গান্ধীসহ কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীদের নীতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন ওই আইএএস আধিকারিক । তার লেখনী থেকেই জানতে পারা যায় যে বর্তমানে পাকিস্তানের যেরকম আর্থিক দুরবস্থা চলছে,ঠিক তেমনই ভারতকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়ে গিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মৃত রাজীব গান্ধী ।
রেড্ডি নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
কংগ্রেসের শাসনকালে আমাদের ৪৭ টন সোনা বন্ধক রাখতে হয়েছিল মাত্র ৪০ কোটি টাকায়।এই ছিল ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে, ভারতীয় অর্থনীতিকে সেই দিন দেখতে হয়েছিল যখন ভারতের মতো একটি দেশকেও বিশ্বব্যাঙ্কে তার সোনা বন্ধক রাখতে হয়েছিল । রাজীব গান্ধীর আমলে দেশের কোষাগার খালি ছিল। আর সেই সময়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এলটিটিই-এর হাতে খুন হন ।
চন্দ্র শেখর তখন নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন । সরকারি কোষাগার ছিল ফাঁকা । কিভাবে তিনি দেশ চালাবেন তা নিয়ে কার্যত অতান্তরে পড়ে যান । কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি । রেড্ডি তার বইয়ে লিখেছেন যে সারা দেশে এক ধরনের হতাশাজনক পরিবেশ ছিল… রাজীব গান্ধী তার শাসনকালে কোনো চাকরির ব্যবস্থা করেননি।
একটি নতুন শিল্প গড়েননি । কারন আপনি যদি একটি ব্যবসা স্থাপন করতে চান, তখন আপনাকে অন্তত পঞ্চাশটি জায়গা থেকে এনওসি আনতে হত । কংগ্রেস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত লাইসেন্স পারমিটের সেই যুগে, চারিদিকে বেকারত্ব এবং হতাশার পরিবেশ ছিল ।
অন্যদিকে, দেশে মণ্ডল ও কমণ্ডলের লড়াই চলছিল । ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত কংগ্রেস দেশের অর্থনীতিকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছিল । একই সময়ে, বোফর্স কেলেঙ্কারি সামনে আসে ।
রেড্ডি বইতে লিখেছেন যে গান্ধী পরিবারের বিপুল লুটপাট দেশের অর্থনীতিকে রসাতলে নিয়ে গিয়েছিল।
রেড্ডি তার বইতে লিখেছেন, সেই দিনগুলিতে, ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কম হয়ে গিয়েছিল যে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বিশ্ব ব্যাঙ্কে তার সোনা বন্ধক রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় । অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, দেশে মাত্র ১৫ দিনের আমদানির টাকা ছিল, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের নির্দেশে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে ৪৭ টন সোনা বন্ধক রেখেছিল ভারত ।
সেই সময়ে, ভারতীয় জনসাধারণের কাছে একটি আকর্ষণীয় এবং বিব্রতকর ঘটনা ঘটেছিল… আরবিআইকে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে ৪৭ টন সোনা জমা করতে হয়েছিল। এটি সেই যুগ ছিল যখন মোবাইল ফোন ছিল না এবং ল্যান্ড লাইনও সীমিত ছিল।
নয়াদিল্লিতে আরবিআই-এর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ভবন থেকে ৪৭ টন সোনা একটি ভ্যানে করে নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে হয়েছিল। সেখান থেকে এই সোনা ইংল্যান্ডে যাওয়ার জাহাজে বোঝাই করার কথা ছিল, অনেক চেষ্টার পর এই ৪৭ টন সোনা ইংল্যান্ডে পৌঁছায় এবং ব্রিটেন ভারতকে মাত্র ৪০.০৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়।
আর আজ সেই কংগ্রেসের নির্লজ্জ নেতারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার অভিযোগ তুলছে, যখন আজ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে এবং দেশ বিশ্বের তৃতীয় আর্থিক শক্তির লক্ষ্যে এগুচ্ছে । অথচ যে কংগ্রেসের শাসনকালে দুর্নীতি ছিল একটা স্বাভাবিক ঘটনা,সেই কংগ্রেসের নেতারাই আজ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে,দেশকে বর্বাদ করে দেওয়ার কথা বলছে । বিশেষ করে দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত কংগ্রেসের জোট শরিক তৃণমূল কংগ্রেস ও ইউপির সমাজবাদী পার্টির মধ্যে এই প্রবনতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে ।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে অদূরদর্শী গান্ধী পরিবার, দেশের সোনা বন্ধক রেখেছিল মাত্র ৪০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার জন্য । একটি দেশের জন্য এর চেয়ে অপমানজনক ও লজ্জাজনক আর কী হতে পারে ? শিল্প নেই,রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ধুঁকছে, দেশ জুড়ে বেকারত্ব, আর এরই মাঝে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি । বহুদিন বাদে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারের সময়, একটি বিখ্যাত কোম্পানি ‘এনরন’ মহারাষ্ট্রের দাভোলে একটি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল । কিন্তু এলাকাবাসীর বাধায় তা সম্ভব হয়নি। ফলস্বরূপ, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ এনরন,৩৮,০০০ কোটি ক্ষতির জন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে। বাজপেয়ী সরকার হরিশ সালভেকে (সালভে আন্তর্জাতিক আদালতে লড়ে কুলভূষণ যাদবের মামলা জিতেছিলেন) ভারত সরকারের আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
কিন্তু জানলে চমকে যাবেন যে এনরনের আইনজীবী হলেন পি চিদাম্বরম ! অর্থাৎ ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে সওয়াল করেছিলেন পি চিদাম্বরম ।
পরে বিজেপি সরকারের পতন হলে সময় ‘ইউপিএ’ সরকার গঠিত হয় । ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন চিদাম্বরম । ফলে এনরনের পক্ষে মামলা লড়তে পারতেন না। কিন্তু তিনি আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে থেকে যান এবং মামলাটি এনরনের পক্ষে পরিণত করতে সক্ষম হন। এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ ! চিদাম্বরম অবিলম্বে এনরন মামলা থেকে হরিশ সালভেকে সরিয়ে দেন। হরিশ সালভের জায়গায় পাকিস্তানি আইনজীবী কুরেশিকে নিয়োগ করা হয়। কুরেশি হলেন সেই একই পাকিস্তানি আইনজীবী যিনি কুলভূষণ যাদব মামলায় পাকিস্তান সরকারের মামলা লড়েছিলেন । তৎকালীন
সরকার, একজন পাকিস্তানি আইনজীবীকে উকিলের ফি হিসেবে ১৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিল । শেষ পর্যন্ত ভারত মামলা হেরে যায় এবং ভারত সরকারকে ৩৮,০০০ কোটি টাকার বিশাল ক্ষতিপূরণ দিতে হয় । কিন্তু ভারতের তাঁবেদার মিডিয়া এই খবরটি সুপরিকল্পিত ভাবে এড়িয়ে যায় ।
এখন ভাবুন ৩৮,০০০ কোটি টাকার মামলা লড়তে পাকিস্তানি আইনজীবীকে কংগ্রেস সরকার দিয়েছিল ১৪০০ কোটি টাকা ! এই নিয়ে কোন হৈচৈ হয়নি । বেমালুম চেপে গিয়েছিল ভারতীয় মিডিয়া । কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর আমলে যদি এই মামলা হতো, আর ভারত সরকার আদালতে হেরে যেত,তাহলে এই কংগ্রেস,কংগ্রেসের জোটসঙ্গী ও তাঁবেদারদের দল দেশ জুড়ে কি হট্টগোল জুড়ে দিত ।
আরও একটি মজার বিষয় হল, যে কোম্পানিগুলো এনরনে বিনিয়োগ করেছিল এবং এই প্রজেক্ট ফাইল করেছিল তাদের বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার । অর্থাৎ সেই সময়ে ডলারের রুপির বিনিময় হার অনুযায়ী তা ছিল মাত্র ১৫৩০ কোটি টাকা । মাত্র সাত বছরে ৩৮,০০০কোটি লাভ ! তাও এক ইউনিট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করেও । বাস্তবিক জহরলাল নেহেরুর সময় থেকেই কংগ্রেসের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল দেশের জন্য ক্ষতিকারক !