১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এই বাহিনী বর্বরতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিল৷ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশি রাজাকাররা । হিন্দু নারীদের গনধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিল ওই বর্বর দলটি । পুরুষ ও শিশুদের গনহত্যা করেছিল । পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলে বাঙালি বীর জগৎজ্যোতি দাস । তার গঠিত “দাস পার্টি” পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ।
বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রে জগৎজ্যোতি দাস ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে এক জীবন্ত আতঙ্ক—মুক্তিযুদ্ধের হাওরাঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দাস পার্টি শত্রুর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল বারবার। একের পর এক সফল লড়াইয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন কীভাবে সাধারণ মানুষও হয়ে উঠতে পারে এক কিংবদন্তি যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিতে জগৎজ্যোতি পাড়ি জমান ভারতের মেঘালয়ের ইকো–১ প্রশিক্ষণ শিবিরে। এর আগেই তিনি গৌহাটির নওপং কলেজে পড়ার সময় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে এবং নকশালপন্থী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন—যার ফলে অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তাঁর গভীর ধারণা ছিল ।প্রশিক্ষণ শেষে গণযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন দুর্ধর্ষ ‘দাস পার্টি’। ইংরেজি, হিন্দি ও গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় দক্ষ হওয়ায় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ভারতীয় সেনাদের সহায়তায় বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদও সংগ্রহ করেন তিনি।
বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ–কিশোরগঞ্জ– নেত্রকোণা –হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করে তার দাস পার্টি। টেকেরঘাট সাব–সেক্টরের অধীনে বিশাল ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর—সবকটি এলাকাই জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে হানাদারমুক্ত ছিল দিনের পর দিন। ক্রমে দাস পার্টি হয়ে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনীর দুঃস্বপ্ন। বাধ্য হয়েই হানাদাররা রেডিওতে ঘোষণা করে—”এই রুটে চলাচলকারীদের জানমালের দায়ভার সরকার নেবে না।” আর তাদের এই ঘোষণাই দাস পার্টির ত্রাসের প্রমাণ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত অপারেশনগুলোর একটি—২৯ জুলাইয়ের জামালগঞ্জ রেইড। সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর নির্দেশে প্রায় ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে দাস পার্টি রাত ১২টার দিকে জামালগঞ্জে আক্রমণ চালায়। অতর্কিত এই হামলায় হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। ভয়ংকর লড়াইয়ের পর তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই অভিযানে দাস পার্টি বদলপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে হানাদারদের হেলিকপ্টার হামলাও মোকাবিলা করে।
আগস্ট মাসজুড়ে তিনি পাহাড়পুর, দিরাই, শাল্লা, রানীগঞ্জ, কাদিরীগঞ্জ—এলাকায় একের পর এক অপারেশন পরিচালনা করেন জগৎজ্যোতি দাস । কখনো গ্রামবাসীর জীবন রক্ষা, কখনো রাজাকারদের ধরপাকড়—সবকিছুতেই তাঁর অসাধারণ যুদ্ধকৌশল ছিল । ১৬ অক্টোবর দাস পার্টির আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বার্জ বিধ্বস্ত হয়, বানিয়াচংয়ে কার্গো ডুবিয়ে দেয় তার যোদ্ধারা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাথা।
কিন্তু শত্রুর চক্ষুশূল হয়ে ওঠায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁর পিছু নেয়। অবশেষে আসে সেই দিন—১৬ নভেম্বর ১৯৭১। ভোর না হতেই ৪২ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন জগৎজ্যোতি দাস। কিন্তু বদলপুরে রাজাকারদের একটি চতুর ফাঁদে পড়েন তাঁরা। জগৎজ্যোতি বুঝতে পারেন চারদিক থেকে হানাদাররা তাঁদের ঘিরে ফেলেছে। তবুও তিনি দমে যাননি। সহযোদ্ধাদের সরে যেতে নির্দেশ দেন এবং নিজে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
গোলাগুলিতে এক সময় সহযোদ্ধা ইলিয়াস আহত হলে নিজের গামছা খুলে তাঁর ক্ষত বাঁধেন জগৎজ্যোতি। ইলিয়াস তাকে সরে যেতে বললেও তিনি যাননি।
একাই লড়তে থাকেন অসংখ্য হানাদারের বিরুদ্ধে—যতক্ষণ না তাঁর গুলি শেষ হয়ে আসে। বিকেলের ম্লান আলোয় শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা তুলতেই একটি গুলি এসে বিঁধে যায় তাঁর চোখে। শহীদ হন বাংলার অমর বীর—জগৎজ্যোতি দাস।
পরের দিন আজমিরীগঞ্জ বাজারে তাঁর লাশ প্রকাশ্যে নির্যাতন করা হয়—পেরেক ঠুকে, থুতু নিক্ষেপ করে, তাঁর পরিবারের সামনে। পরে গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তাঁর বাড়ি। শেষ পর্যন্ত তাঁর দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে—যার জলে আজও যেন ভেসে বেড়ায় বাংলার এক অমর যোদ্ধার আত্মত্যাগের গাথা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিও, আকাশবাণী—সব জায়গায় তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণার কথা জানানো হয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিয়ে তাঁকে দেওয়া হয় দুই ধাপ নিচের ‘বীরবিক্রম’ খেতাব।
বাংলাদেশ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে । কিন্তু এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে তার বীরত্বের কাহিনী ।।

