এইদিন ওয়েবডেস্ক,ভাতার(পূর্ব বর্ধমান),১৮ ফেব্রুয়ারী : ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে দেশজুড়ে বর্তমানে তোলপাড় চলছে । এআইএমআইএম, কংগ্রেস, বামপন্থী, আম আদমি পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসের মত রাজনৈতিক দলগুলো ওয়াকফ আইন সংশোধনীর বিরোধিতায় সরব হচ্ছে । শুরু হয়েছে শাসক ও বিরোধীদের চাপানউতোর । ঠিক তারই মাঝে পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার কাপশোড় গ্রাম্য মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে । ভুয়া নথি দেখিয়ে ২৪ জন গ্রামবাসীর বসত বাড়ি এবং জমি রেকর্ড করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে । তার মধ্যে রয়েছে দুই বিধবাসহ ৪ হিন্দু চাষির জমিও । এই জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে খোদ ভাতার ভূমি এবং ভূমি সংস্কার অফিসের একজন আরও(RO)-এর বিরুদ্ধেও । এক সপ্তাহ আগেই নিজেদের বসত বাড়ি ও জমি ফেরত পেয়েছিলেন কাপশোড় গ্রামের ২০ জন গ্রামবাসী । আজ মঙ্গলবার ভাতার বিএলআরও অফিসে জেলা প্রশাসন, ভাতারের বিধায়ক, ভাতার থানার অফিসার ইনচার্জের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে অবিলম্বে ৪ হিন্দুর জমির রেকর্ড সংশোধন করে দেওয়া হবে । এই মামলায়( কেস নম্বর এমএন/২০২৪ /০২০৮/২২৪০৪) ডবলুবিএলআর ১৯৫৫ আইনের ৫০ ধারার অধীনে দপ্তর অমৃতা ঘোষের ১০ শতক, মৃত সুনীল ঘোষ ও ছায়ারানী ঘোষ মিলে ৭ শতক এবং বিশ্বনাথ সোমের ১৪ শতক জায়গার রেকর্ড মসজিদ কমিটির পরিবর্তে ওই চার গ্রামবাসীর নামে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে । দপ্তরের অর্ডার শিট এইদিন-এর কাছে আছে ।
ভাতাড় থানার কাপশোড় গ্রামের বাসিন্দা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান,যাদের জমি মসজিদের নামে রেকর্ড হয়েছিল, ওই তালিকায় একজন বিধবা মহিলাসহ ৪ জন হিন্দুও রয়েছেন । তারা হলেন অমৃতা ঘোষ, স্বামী গদাধর ঘোষ, তার ১০ শতক জমি রেকর্ড করে নেওয়া হয় ।
মৃত সুনীল ঘোষ ও তার বিধবা স্ত্রী ছায়ারানী ঘোষের ৭ শতক এবং বিশ্বনাথ সোম নামে একজন গ্রামবাসীর ১৪ শতক রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালে আবুল কাশেমের কাছে জমি কিনেছিলেন আমাদের দাদু । ১৯৮৪-৮৫ সালে রেকর্ড করি । তার মধ্যে একটা জমি দাদা বিক্রি করে দেয় । তারপর একদিন হঠাৎ মসজিদ কমিটির কলিম ও তারা মণ্ডল নামের একজন বলল যে ‘তোর দাদার জমি লিখে নিয়েছি’ । আমি আকাশ থেকে পড়ি । কারণ দলিল এবং পরচা সবই রয়েছে আমাদের । তারপর মাঝখানেক আগে একদিন হঠাৎ আমাদের জমির চাষ করে নিল । বিষয়টা হিন্দু-মুসলিম হয়ে যাবে বলে এবং আমাদের ক্ষমতা কম থাকায় আমরা কিছু বলতে পারিনি । কিন্তু পাঁজা বাড়ির সম্পত্তি নেয়নি । কারণ তারা মসজিদ কমিটির প্রিয়পাত্র ।’ তিনি বলেন,’আমরা বিএলআরও, এডিএমসহ বিভিন্ন অফিস ছোটাছুটি করেছি জমি ফিরে পাওয়ার জন্য । কিন্তু বিএলআরও হামলার ভয়ে কম্পিউটারে জায়গার মালিকানা নাম সংশোধনে রাজি হননি । কারন ইতিমধ্যেই মসজিদ কমিটির লোকজনরা বিএলআরও অফিসে হামলা করেছিল । আমরা বহু কষ্ট করেছি । অবশেষে যে ন্যায় বিচার পেলাম এটাই যথেষ্ট এবং আমরা খুব খুশি ।’
জানা গেছে, মাস দুয়েক আগে জনৈক এক চাষী নিজের জমির মিউটেশন করতে গিয়ে জানতে পারেন যে তার জমি মসজিদ কমিটির নামে রেকর্ড হয়ে গেছে । তবে শুধু ওই চাষী নয় গ্রামের অন্তত ২৪ জনের সম্পত্তি নিজের নামে রেকর্ড করে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে । তারমধ্যে ৯টি বসত বাড়ি ও রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ব্যক্তি । চার হিন্দুর জমি রয়েছে চন্ডীপুর মৌজায় । এবং বাকিদের বাড়ি ও জমি রয়েছে কাপশোড় মৌজায় । এক একটা জমি ৬ থেকে ৮ কাঠা পরিমাণ জমি মিলে মোট সাড়ে ৮ বিঘা জমি মসজিদ কমিটি নামের রেকর্ড হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
জানা গেছে,গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ভাতার বিএলআরও-এর কাছে এনিয়ে গন অভিযোগপত্র জমা দিয়েছিলেন কাপশোড় গ্রামের কয়েকজন চাষী ৷ মোহাম্মদ ইব্রাহিম শেখ, বাবুসোনা সেখ, মেহের আলী শেখ, বিশ্বনাথ সোমসহ ৯ জনের স্বাক্ষরিত ওই অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছিল,’ভাতাড় থানার কাপশোড় (জে এল ৪০) ও চন্ডিপুর (জে এল ৪১) মৌজার বেশ কিছু জমি জায়গা কাপশোড় মসজিদ কমিটি দফায় দফায় একাধিক জাল দলিল দাখিল করে LR রেকর্ড পরিবর্তন করে নিয়েছে। মৃত ব্যক্তির নামেও জাল দলিল করে, মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। এই অপরাধমূলক কাজে একই সাথে আপনার BLRO অফিসের স্টাফেরা জড়িত, তারা অর্থের বিনিময়ে কোন নোটিশ,এনকোয়ারি ছাড়াই রেকর্ড পরিবর্তন করে দিয়েছে। দফায় দফায় এতগুলো জমির রেকর্ড পরিবর্তন করেছে অথচ আমরা কাপশোড়-চন্ডিপুর কোন গ্রামের কোন ব্যক্তি নোটিশ পেলাম না, কোন এনকোয়ারি হল না, হিয়ারিং হল না, আমাদের কাগজপত্র দেখানোর কোন সুযোগ দেওয়া হল না। Order Sheet এ উল্লেখ করেছে The petitioner is in possession of the scheduled property যা সর্বৈব মিথ্যা। এসব জমি আমরা ৬০/৭০ বছর ধরে চাষাবাদ করে আসছি, এখনও জমিতে আমাদের পাকা ধান রয়েছে। জালিয়াত চক্রের জন্য আমাদের সম্পত্তির কোন নিরাপত্তা নাই। সেজন্য আমাদের দাবী : ১। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রেকর্ড সংশোধন করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক।২। জালিয়াতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
জানা গেছে, ১৫/০৮/ ১০৮০ তারিখের ০০৫১৭৪ নম্বরের দলিল দেখিয়ে ১৭৮৫ দাগে মৃত সুনীল ঘোষের ২ শতক, একই দাগে তার স্ত্রী ছায়ারানীর ৫ শতক, ১৭৯২ দাগে বিধবা অমৃতা ঘোষের ১০ শতক এবং ১৯১৬ দাগের বিশ্বনাথ সোমের ১৪ শতক পরিমান রেকর্ড করে নিয়েছিল কাপশোড় গ্রাম্য মসজিদ কমিটি । যদিও ভূমি দপ্তর জানায় যে তারা তদন্তে জানতে পারে ০০৫১৭৪ নম্বরের দলিলটি জাল । গত মঙ্গলবারই কাপশোড় ও চন্ডীপুর মৌজার ২৪ জন প্রতারিত গ্রামবাসীর জায়গার রেকর্ড সংশোধন করার কথা ছিল । কিন্তু সেদিন কমিটির লোকজন এসে ভাতার বিএলআরও অফিসে ঝামেলা পাকায় । ফলে ২০ মুসলিমের জমি ও বাড়ির রেকর্ড সংশোধন হলেও বাকি ৪ হিন্দুর জমির রেকর্ড সংশোধনের ঝুঁকি নিতে চাননি বিএলআরও । যদিও পরের মঙ্গলবার অর্থাৎ আজ রেকর্ড সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং যথারীতি সংশোধনও করে দেওয়া হয়েছে ।
কিন্তু গত মঙ্গলবার কাপশোড় গ্রাম্য মসজিদ কমিটি ও গ্রামবাসীদের বিএলআরও অফিসে ঝামেলা পাকানোর নেপথ্যে এমনই আরও এক অনিয়ম প্রকাশ্যে আসে । স্থানীয় সূত্রে খবর, জেএল ৪০ এবং কাপশোর মৌজায়
দত্তপুকুরের ৩ একর ৯০ শতকের মধ্যে ১ একর ৯৫ শতক জায়গা খেলার মাঠকে ১৯৯১ সালে দান করেছিলেন জনৈকা সুষমা চৌধুরী নামে এক মহিলা । পরে ওই দাগের ৯৫ শতক পরিমান জায়গা কাপশোড় গ্রাম্য মসজিদ কমিটিকে বিক্রি করেন আর এক শরিক অভয়পদ চক্রবর্তী । কিন্তু পরে কেনা জায়গা ছাড়াও খেলার মাঠের জন্য সুষমা চৌধুরীর দান করা জায়গাটিকেও মসজিদ কমিটির নামে রেকর্ড করে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ । যা ঘিরে গ্রামে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় । কিন্তু বেআইনি কাজ করেও কমিটির সদস্য ও গ্রামের একাংশ মঙ্গলবার ভাতার বিএলআরও অফিসে এসে গোটা জায়গাটি মসজিদের নামে রেকর্ডের দাবি করে । তারা অফিসের কাচের জানালা ভাঙচুরও করে বলে অভিযোগ ।
এদিকে সমগ্র এই দুর্নীতিতএ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কথামত সেই ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা’ বিএলআরও অফিসের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে । বিষয়টি নিয়ে জানতে ভাতার বিএলআরও প্রদীপ মণ্ডলকে ফোন করা হলে তিনি, ‘আপনাকে পরে ফোন করে বলছি’ বলে এড়িয়ে যান । এদিকে বারবার ভাতার ভূমি দপ্তরের আধিকারিকদের একাংশের অর্থের বিনিময়ে এহেন অনৈক কাজের অভিযোগ ওঠায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এলাকায় । এই অনিয়মে জড়িত মসজিদ কমিটির সদস্যদের পাশাপাশি বিএলআরও অফিসের এক আধিকারিকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলছেন এলাকার বাসিন্দারা । সমগ্র ঘটনাকে ঘিরে তোলপাড় পড়ে গেছে গোটা জেলা জুড়ে৷।