এইদিন ওয়েবডেস্ক,ঢাকা,২১ মে : বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারীপাচারের জন্য সিংহভাগ ক্ষেত্রে কলকাতাকে করিডর হিসাবে ব্যবহার করছে সেদেশের নারী পাচার চক্র । বিয়ে, মডেলিং, বিদেশে চাকরিসহ নানা ধরনের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশী অল্প বয়সী মেয়েদের প্রথমে কলকাতাতে আনা হয়,তারপর তাদের দেহ ব্যবসায় জন্য পাচার করে দেওয়া হয় ভারতের অনান্য রাজ্যে । নারী পাচার চক্রের ফাঁদ থেকে এমন অনেক বাংলাদেশী তরুনীকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) নামে একটি সংস্থা উদ্ধার করেছে । ফিরে আসার পর ওই সমস্ত মহিলাদের বয়ানে এমনই তথ্য উঠে এসেছে ।
বাংলাদেশের একটি দৈনিক সংবাদপত্রে পাচারকারীদের খপ্পর থেকে উদ্ধার হওয়া ৩ জন মহিলার কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে । প্রতিবেদন অনুযায়ী,এমনই এক মহিলা হলেন বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার বাসিন্দা মিনা (ছদ্মনাম) । বিয়ের পর তার বাবা কুমিল্লায় শ্বশুরবাড়িতে চলে আসেন । কিন্তু এক ভাই চার বোনের মধ্যে বড় মিনা থেকে যান রাজবাড়ীতে দাদু ও ঠাকুমার কাছে । সেখানেই মিনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে স্থানীয় এক যুবকের । বছর ১২ আগে মীনাকে মোটরসাইকেলে করে কলকাতায় নিয়ে যায় তার প্রেমিক । তারপর মিনার প্রেমিক গোয়ায় বেড়ানোর কথা বলে তাকে দেহব্যবসায় লাগিয়ে দেয় । দিল্লির একটি পার্টনার এনজিওর মাধ্যমে বিএনডব্লিউএলএ মিনার খোঁজ পেলে ওই সংস্থা তাকে উদ্ধার করে । ওই এনজিওর সহযোগিতায় কয়েক মাসের মধ্যে মিনাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ট্রমায় আক্রান্ত মিনার মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায় । যদিও পরিবার পরিজনের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন মিনা । যদিও পরে পাচার মামলায় তাকে ফের গোয়ায় যেতে হয়েছিল । তাঁকে প্রায় দু’বছর সেখানে থাকতে হয় । সেই সময়কালে মিনা যে হোমে মিনা ছিলেন, সেখানে ইংরেজি ভাষা ও কম্পিউটার ব্রাউজিংয়ে তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। দেশে ফিরে একটি পাঁচতারকা হোটেলের রিসিপশনিস্টের কাজ নেন । এর মধ্যে গাড়ি চালানোও শিখেছেন। পরবর্তী কালে কোম্পানির কাজে ফের তাকে ভারতে আসতে হয়েছে । ফিরে এসে নিজের উপার্জনে তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন । বছর তিনেক আগে বিয়ে করে এখন সংসার করছেন মিনা ।
নারী পাচারচক্রের ফাঁদে পড়া দ্বিতীয় মহিলা হলেন বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার বাসিন্দা কবিতা (নাম পরিবর্তিত) । কবিতার বাবা দিনমজুর।দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অত্যন্ত হতদরিদ্র পরিবার । পারিবারিক অভাবের কারনে সপ্তম শ্রেণির পরেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় কবিতাকে ।
সংসারের খরচ চালাতে বাবাকে সহায়তা করার জন্য মাত্র মাত্র ১৮ বছর বয়সে গাজীপুরে একটি গার্মেন্টে কারখানায় কাজে লাগেন তিনি । সেখানেই এক যুবকের সাথে প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেন কবিতা । প্রেমিক পেশায় গাড়িচালক । করোনা মহামারী শুরু হওয়ার প্রথম দিকে কাজ চাকরি চলে যায় ওই তরুনীর । বাধ্য হয়ে তিনি বাপের বাড়ি ফিরে আসেন । প্রথম দিকে তার স্বামী মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাতো । কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার পরেই সরে পড়ে কবিতার স্বামী । ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ওই তরুনী । আর তখনই তিনি তার এক প্রতিবেশী মহিলার ফাঁদে পড়ে যান । ওই মহিলা তাকে ভারতে পার্লারে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখায় । কবিতা রাজি হয়ে গেলে তাকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে জলপথে বেআইনিভাবে সীমান্ত পার করে কলকাতায় আনা হয় । কলকাতায় দিন সাতেক রেখে কবিতার নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে নারী পাচারকারীরা । এরপর সেখান থেকে তাঁকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় হায়দরাবাদে। সেখানে হোটেলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেহ ব্যবসায় যুক্ত হতে বাধ্য করা হয় । কবিতা অপরাধীদের যে আস্তানায় ছিলেন, সেখানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করে । তাকে একটা বেসরকারি হোমে পাঠানো হয় । প্রায় ১১ মাস ওই হোমে থাকার পর বিএনডব্লিউএলএর সহযোগিতায় ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে কবিতা বাংলাদেশে ফিরে আসেন । বর্তমানে নিজের সেলাই মেশিনে ঘরে বসেই উপার্জনের করছেন ওই তরুনী । গত বছর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় ।
তৃতীয় মহিলা হলেন বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দা হালিমা বেগম (ছদ্মনাম) । তার বাবা একজন দিনমজুর। তাঁরা দুই বোন । ১৮ বছর বয়সে একই এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ করিম নামে এক যুবকের সঙ্গে হালিমার বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার । বিয়ের পর থেকেই অতিরিক্ত পনের দাবিতে হালিমাকে মারধর ও নির্যাতনের শুরু করে স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন । বাধ্য হয়ে হালিমার বাবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তখন হালিমা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী । বাবার বাড়িতে চলে আসার কিছুদিন পর হালিমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে করিম । সে নিজের ভুল নিয়ে অনুশোচনা করলে হালিমার মন গলে যায় । একদিন মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার অছিলায় করিম তার প্রাক্তন স্ত্রী হালিমাকে সাতক্ষীরা শহরে আসতে বলে । বাবাকে না জানিয়েই হালিমা স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে পৌঁছালে তাঁকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয় নারী পাচারকারীরা । তাঁকে অচেতন করে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আনা হয় ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী,জ্ঞান ফেরার পর হালিমা দেখে তাকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে । ঘরের বাইরে পাহারা দিচ্ছে তিন-চারজন পুরুষ । হালিমা তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, করিম তাকে ২,০০,০০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে । সে বর্তমানে কলকাতায় আছে । হালিমাকে পাঁচ-ছয় দিন ওই ঘরে আটকে রাখা হয় । আর প্রতিদিনই সে গনধর্ষণের শিকার হয় । পরে হালিমাকে কলকাতার নারী পাচারকারী আর একটা চক্রের হাতে তুলে দেওয়া হয় ৷ ওই চক্রটি হালিমাকে ট্রেনে মুম্বাইয়ে পাচারের যাওয়ার চেষ্টা করে । কিন্তু হালিমার কান্নাকাটি দেখে সন্দেহ হয় ট্রেনের টিকিট পরীক্ষকের ৷ শেষ পর্যন্ত টিটির তৎপরতাতেই রেল পুলিশ উদ্ধার করে হালিমাকে । অবশ্য তার আগেই চম্পট দেয় পাচারকারী চক্রের দুই পান্ডা । এদিকে হালিমাকে আদালতে তুলে একটি সরকারি হোমে রাখা হয় । পরে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) তাকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।
বিএনডব্লিউএলএ-এর সারভাইভার সাপোর্ট কো-অর্ডিনেটর দীপ্তি বল বলেন, আট মাসের মাথায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) হালিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। মামলার প্রাথমিক কাজ শেষ করে তিনি বাবার সঙ্গে ঢাকায় মহিলা আইনজীবী সমিতির শেল্টার হোমে আসেন। সেখানে বসেই তিনি পড়াশোনা করেন। পরে বাড়িতে গিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। তাঁর পুলিশে কাজ করার খুব ইচ্ছা । তিনি সম্প্রতি সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ।।