এইদিন ওয়েবডেস্ক,২০ মে : পৃথিবীর ইতিহাসে যে সমস্ত নরসংহার সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের খুলনার চুকনগরে হিন্দু নরসংহার । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আবহে ১৯৭১ সালের বছরের ২০ মে খুলনার ডুমুরিয়ার ছোট্ট শহর চুকনগরে পাকিস্তানের বর্বর সেনা ও বাংলাদেশি রাজাকাররা এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটায় । অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১০,০০০-১২,০০০ হিন্দুকে গুলি করে, কুপিয়ে ও পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে । বাদ যায়নি শিশু,মহিলা ও বৃদ্ধ বৃদ্ধারা । ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের হিংসার শিকার সেই সমস্ত নিরীহ হিন্দুদের আজ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ও ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় ।
বাংলাদেশের খুলনার চুকনগরের হিন্দু নরসংহারের পর অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ ও মুনতাসির মামুন প্রায় ২০০ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিলে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । প্রত্যক্ষদর্শীরা ওইদিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন তাদের । সেই মৌখিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যে পাকিস্তানের নরপশু সেনারা বাংলাদেশের মৌলবাদী রাজাকারদের সাথে সাথে নিয়ে নির্বিচারে হিন্দুদের খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছিল । ১৯৭০ সালের ২৫শে মার্চের রাত থেকে বাংলাদেশি রাজাকারদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী হিন্দু বাঙালিদের গনহত্যা শুরু করে। রাজাকাররা গণহত্যাকে পরিকল্পিত গণহত্যায় রূপ দেয় । প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় খুলনাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুরা ।
মে মাসের মাঝামাঝি সময় বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট,রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, বংলা, ডাকপ,বছিয়াঘাটা, চালনা, হরিপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার হিন্দু ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভারতে যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে বেছে নেন ডুমুরিয়ার চুকনগরকে । আগের দিন, ১৯ মে রাতে, কয়েক হাজার শিশু মহিলা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চুকনগরে এসে পৌছান ।
পরের দিন সকালে সাতক্ষীরা এবং কলারোয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল । গোটা এলাকাটা ছিল কালো মাথায় ঢাকা । কোথাও তিল ধারণের জায়গা ছিল । হাজার হাজার মানুষ চুকনগরের পাতখোলা বাজার,কাঁচা বাজার চাঁদনী, ফুটবল মাঠ, কালীমন্দি, এমনকি এলাকার শ্মশানগুলিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই সময় পাকিস্তানের সেনার ৩ টি ট্রাক চুকনগরের পাতখোলা বাজারে এসে থামে,যা বর্তমানে ঝাউতলা নামে পরিচিত । তাদের সঙ্গে ছিল হালকা মেশিনগান ও সেমি অটোমেটিক রাইফেল । পাকিস্তানি সেনা ছাড়াও নরসংহারে যোগ দেয় বাংলাদেশী মৌলবাদী রাজাকাররা ।
সকাল থেকে শুরু করে দুপুর তিনটে পর্যন্ত তারা হিন্দু নরসংহার চালায় । তারা প্রথমে নির্বিচারে গুলি চালায় প্রথমে । গুলি শেষ হয়ে গেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিশু ও মহিলা নির্বিশেষে কোপাতে শুরু । চারিদিকে তখন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশের সারি । চুকনগরের ভদ্রা নদীর জলে ভাসছে অগণিত রক্তাক্ত লাশ । রক্তে লাল হয়ে যায় নদীর জল । বাঁচার জন্য যারা নদীতে লাফিয়ে পড়েছিলেন তারা স্রোতের টানে তলিয়ে যান । সেই ভয়াবহ দিন,১৯৭১ সালের ২০ মে, বৃহস্পতিবার, চুকনগরে হিন্দু নরসংহারের পর কয়েক মাস ধরে গোটা এলাকা লাশ পচা গন্ধে ভরে যায় । মৃতদেহগুলি শকুন, কাক ও কুকুরের দল ছিড়ে খায় ।
মৃতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তথাগত রায় টুইট করেছেন,’যা আপনি হয়তো জানেন না। আজ ২০মে, চুকনগর দিবস। একটি নিরস্ত্র নিরপরাধ নিরীহ অসহায় জনগোষ্ঠীর আন্দাজ দশ হাজার মানুষকে, যাদের মধ্যে ছিল প্রচুর নারী ও শিশু, ১৯৭১ সালে এই দিনটিতে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা জেলার চুকনগর গ্রামে গণহত্যা করেছিল পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী। এরা কারোর কোনো ক্ষতি করে নি, এদের একমাত্র অপরাধ ছিল এরা হিন্দু। জড় হয়েছিল, প্রাণের ভয়ে, মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে ভারতের বসিরহাটে পালাবার উদ্দেশ্যে।পাকিস্তানপন্থী বাঙালি মুসলমান রাজাকারেরা এই খবর যশোরে পাকিস্তানী সৈন্যঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়। তারপরে নির্বিচারে গুলি চলে। গুলি শেষ হয়ে যাবার পর সৈন্য ও রাজাকারেরা পিটিয়ে, খুঁচিয়ে বহু হিন্দু হত্যা করে। পাশ দিয়ে বহমান ভদ্রা নদীর জল লাল হয়ে গিয়েছিল হিন্দুর রক্তে।এরা ছিল আমার-আপনার মতই বাঙালি হিন্দু। একফোঁটা চোখের জল ফেলুন এদের জন্য।এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় উদারপন্থী লেখক মুনতাসির মামুন। তাঁকে প্রণাম জানাই।’
শুভেন্দু অধিকারী লিখেছেন,’১৯৭১ সালের ২০শে মে, খুলনার চুকনগরে পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশের মৌলবাদীদের নিয়ে একযোগে দশ হাজার হিন্দুদের হত্যা করেছিল। পৃথিবীতে একদিনে এতবড় পৈশাচিক গণহত্যা কখনও হয়নি । চুকনগর গণহত্যায় আত্মবলিদানকারী সকল শহীদদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।’।

