শ্যামসুন্দর ঘোষ,মন্তেশ্বর(পূর্ব বর্ধমান),০৭ নভেম্বর : “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশে তবু রঙ্গে ভরা”…. বিধর্মী হানাদারের আক্রমণ,দেশ বিভাজন, কত কিছুর সম্মুখীন হয়েছে এই বাংলা । তারপরেও দুই বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীরা নিজের সভ্যতা সংস্কৃতিকে ভুলে যায়নি । বাউল, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, কীর্তন, গাজন, ভাদুগান, ঝুমুর গান,ঘেঁটু গান, সারি গান, বারোমাসি, মেয়েলি গীত, চোকচুন্দ্রী, ধামগান, ক্ষণগান, চোরচুন্নি ইত্যাদি কত না লোকসংগীত ছিল এই বাংলায় । কালক্রমে সেই সমস্ত প্রাচীন ঐতিহ্যের ব্যপকতা হ্রাস পেলেও আজও গ্রাম বাংলার কিছু মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিকিয়ে রেখেছে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে । এমনই এক লোকগান হল…” বাদাই” । শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী এবং মহাভারত থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন-উত্তর মূলক এই লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যেকে আজও টিকিয়ে রেখেছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের অন্তর্গত পিপলন অঞ্চলের করন্দা গ্রামের লোক শিল্পিরা । শিল্পিরা প্রত্যেকেই হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য । মেলেনা তেমন সরকারি সহায়তা ৷ কিন্তু তারা পূর্ব পুরুষদের এই গানকে টিকিয়ে রাখতে গ্রামে চাঁদা তুলে প্রতিবছর বাদাই উৎবের আয়োজন করে আসছেন ।
গত মঙ্গলবার থেকে করন্দা গ্রামে শুরু হয়েছিল বাদাই উৎসব ৷ চলে দু’দিন । করন্দা হংসধনী গীতিনাট্য সংস্থার ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক বছরের মত এবারেও এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল । অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে বাঙালির এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরে আসছে ওই সংস্থাটি । করন্দা গ্রামে হংসধ্বনি গীতিনাট্য সংস্থা শিল্পীরাই বাদাই গান লেখেন এবং সুর দেন। সংস্থার পুরুষ শিল্পীরাই শুধুমাত্র বাদাই গানে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামের বিভিন্ন পাড়া মিলে ২৭ টি জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাদাই গানের মাধ্যমে পুরুষরা মহিলা সেজে শ্রোতাদের আনন্দ দিলেন শিল্পিরা । শাস্ত্র বিমুখ মানুষের সামনে তুলে ধরলেন রামায়ন ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী । পাশাপাশি গ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের কৃতী পড়ুয়াদের সংস্থার তরফে পুরস্কৃত করা হয়। মাধ্যমিকে ৩ জন এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ৩ ছাত্র-ছাত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
গ্রামবাসী উজ্জ্বল দে বলেন,’এখন তো বাদাই গান শোনাই যায় না । কেবলমাত্র আমাদের করন্দা গ্রামের শিল্পিরা ৮০-১০০ বছর ধরে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন । আশপাশের দু’একটা গ্রামে বাদাই গানের আয়োজন করা হয় কিন্তু তাদের ধারাবাহিকতা নেই ।’
হংস ধ্বনি গীতি নাট্যের সম্পাদক রাজীব মুখার্জি বলেন,’এবারে বাদাই গানের উৎসবে মোট ২৪ টি দল অংশগ্রহণ করেছিল । গ্রামের প্রতিটি পরিবারের আত্মীয় স্বজনরা এসেছিলেন । দু’দিন গ্রামে একটা মিলনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল ।’ মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করা কালীরাম রাজবংশী বলেন,’দর্শকদের আগ্রহই আমাদের অনুপ্রেরণা । যত দারিদ্রর সম্মুখীন হই না কেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের এই ঐতিহ্যকে আমরা কিছুতেই হারিয়ে যেতে দিতে দেব না ।’।